Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাখাদ্য ও পানীয় Food & Drinks

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ঘরোয়া উপায়  Home Remedies for Constipation Relief

আজকের ব্যস্ত জীবনে কোষ্ঠকাঠিন্য বা Constipation খুব সাধারণ একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সকালে পেট পরিষ্কার না হওয়া, পেট ব্যথা, পেট ফাঁপা, গ্যাস, বুক জ্বালা, মাথা ধরা, এসবই হল কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ। ওষুধ খেলে সমস্যা সাময়িক কমে, কিন্তু সমস্যার মূল কারণ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। এই প্রতিবেদনে এমন কিছু ঘরোয়া, প্রাকৃতিক ও আয়ুর্বেদিক উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ও হজম শক্তি বাড়ায়।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করার জন্য কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ সম্পর্কে জানা দরকার। বিভিন্ন কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে।

খাদ্য তালিকায় ফাইবার যুক্ত খাদ্যের পরিমাণ কম হলে এবং পর্যাপ্ত জলপান না করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বৃদ্ধি পায়। যারা অতিরিক্ত চিন্তা করেন, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতায় ভোগেন, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে। মানসিক চাপ থাকলে হজমের সমস্যা হয় ও ইরিট্যাবল বাওয়েল সিনড্রোমের মত রোগের সূচনা হয়। অতিরিক্ত দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য ও মাংস জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়। দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন হলে, ঘুমের সমস্যা হলে বা ভ্রমণ করলে হজমের সমস্যা হয় ও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

কিছু ওষুধ যেমন ক্যালসিয়াম বা অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় অ্যান্টাসিড, রক্তচাপের ওষুধ, মানসিক চিন্তা কমানোর ওষুধ ইত্যাদি গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এছাড়া থাইরয়েডের রোগ, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, স্নায়ু রোগ ইত্যাদি সমস্যায় কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

দেহে জলের অভাব হলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে। এটি প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত জল পান করা দরকার। জল ছাড়াও সফট ড্রিংকস গ্রহণ করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে জল পান বেশ কার্যকর। তবে বেশ কিছু ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চিনিযুক্ত পণীয় ব্যবহার করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়, সেক্ষেত্রে চিনিযুক্ত পাণীয় গ্রহণ করা চলবে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক-গ্লাস গরম জল পান করলে পেটে গ্যাস অম্বলের সমস্যা হয় না, অন্ত্র সক্রিয় হয় ও মলত্যাগ সহজ হয়। প্রয়োজনে গরম জলের সাথে এক চামচ লেবুর রস ও এক চিমটি লবণ মিশিয়ে পান করতে হবে। এটা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করবে।

ফাইবার যুক্ত খাদ্য বেশি পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে দ্রবণীয়, নন ফার্মেন্টেবল ফাইবার বেশি খেতে হবে। ফাইবার গ্রহণ করলে মলের পরিমাণ বাড়ে ও মলত্যাগ সহজ করে তোলে। এছাড়া ফাইবার যুক্ত খাদ্য পাচনতন্ত্রের চলন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে ফাইবার দারুণ কাজ করে। তবে এটাও দেখা গিয়েছে যে ফাইবার পেটের ব্যথা ও ফোলা কমাতে তেমন কার্যকর নয়। এর কারণ হল বিভিন্ন ধরনের ডায়েটরি (Dietary) ফাইবার হজমের উপর বিভিন্ন রকম প্রভাব ফেলে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ফাইবার যুক্ত শাকসবজি যেমন ঢেঁড়স, পালং শাক, লাউ, করলা ইত্যাদি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া প্রধান খাদ্য হিসাবে ওটস, চিড়া, গমের রুটি ও ফলের মধ্যে আপেল, কলা, পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসায় সবথেকে ভালো কাজ করে ইসবগুলের ভুষি। রাত্রে শোয়ার আগে গরম দুধ বা হালকা গরম জলের সাথে এক চামচ ইসবগুলের ভুসি গ্রহণ করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে যায়।

যারা শারীরিক কসরত কম করেন, তাদের থেকে যারা শারীরিক কসরত করেন বা কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কম হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ব্যায়াম করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে। এক্ষেত্রে হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম বেশি কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যায়াম করলে পৌষ্টিকতন্ত্রের চলন স্বাভাবিক থাকে, ভেগাস নার্ভের কাজ উন্নত হয় ও অন্ত্রে হরমোনের নিঃসরণ স্বাভাবিক থাকে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম যেমন হাটা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, জগিং ইত্যাদি করতে হবে। তবে ওজন নিয়ে ব্যায়াম না করাই ভালো।

আমাদের শরীরের মধ্যে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে। এদের বেশিরভাগই থাকে আমাদের অন্ত্রে। এই সকল ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের ক্ষতি করে, আবার কিছু ব্যাকটেরিয়া আমাদের উপকার করে। আমাদের শরীর সুস্থ থাকার জন্য উপকারী ও অপকারী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। ভারসাম্য নষ্ট হলে আমাদের দেহে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, উপকারী ব্যাকটেরিয়া যুক্ত খাদ্য অর্থাৎ প্রোবায়োটিক গ্রহণ করলে আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় ও হজমের সমস্যা কমে। একারণে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে প্রোবায়োটিকযুক্ত খাদ্য যেমন দই, লস্যি, রাইতা, পনির, আচার, ইডলি, ধোসা ইত্যাদি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

মাথা ও পেটের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক আছে। পেটের স্বাস্থ্য অনেকটা নির্ভর করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর। উদ্বেগ, বিষণ্ণতা ইত্যাদি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দেয়। যখন আমরা মানসিক চাপে থাকি তখন দেহে অতিরিক্ত ট্রেস হরমোন উৎপন্ন হয় ও হজমের প্রক্রিয়ায় ব্যাহত হয়। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাকে খুব জটিল করে তোলে। আর একারণে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরী একটা বিষয়। মানসিক চাপ কমাতে দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া, ধ্যান, প্রাণায়াম, যোগব্যায়াম ইত্যাদি দারুণ কাজ করে। এছাড়া সমস্যা বেশি হলে অবশ্যই একজন মনঃচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। মানসিক সমস্যা কমে গেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও কমে যায়।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এক গ্লাস গরম জলে এক বা দু চামচ মধু মিশিয়ে পান করতে হবে। মধু হজমে সাহায্য করে ও অন্ত্রের চলন স্বাভাবিক রাখে। এই মিশ্রণটি খালি পেটে পান করলে বেশি ভালো কাজ করে। চাইলে এই মিশ্রণে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করা যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে এই মিশ্রণটি পান করলে উপকার পাওয়া যায়।

এক কাপ গরম দুধে এক থেকে দুই চামচ ঘি মিশিয়ে রাত্রে ঘুমানোর আগে পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে। ঘি একটি চমৎকার ল্যাক্সেটিভ হিসাবে কাজ করে ও হজমে সাহায্য করে। এটি আয়ুর্বেদের একটি প্রমাণিত চিকিৎসা পদ্ধতি।

ত্রিফলার মধ্যে থাকে আমলকী, হরিতকী ও বহেরা। ত্রিফলা চূর্ণ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমাতে দারুণ কার্যকর। এক গ্লাস হালকা গরম জলে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ মিশিয়ে রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পান করতে হবে। এটি অন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করতে ও হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ ভালো কাজ করে। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের জন্য ত্রিফলা চূর্ণ একদম নিরাপদ বলে মনে করা হয়, তবে গর্ভবতী মহিলাদের ত্রিফলা এড়িয়ে চলা উচিত।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় পাকা কলা বেশ উপকারী। পাকা কলায় দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয়  ফাইবার থাকার কারণে হজমের প্রক্রিয়ার সহজ হয় ও মল নরম থাকে। এছাড়া পাকা কলায় থাকে পটাশিয়াম যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এক থেকে দুটি পাকা কলা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। তবে কাঁচা বা সবুজ কলা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়তে পারে, কারণ এতে প্রচুর স্টার্চ থাকে, যা হজম করা কঠিন।

চায়ের সাথে মৌরি, আদা বা জবা ইত্যাদি মিশিয়ে ভেষজ চা তৈরি করে পান করলে হজমের প্রক্রিয়া উন্নত হয়। এছাড়া লেবু, শসা, পুদিনা, দারচিনি, আদা, বেরি, আপেল ইত্যাদি দিয়ে পানীয় তৈরি করে পান করলেও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে। এই ভেষজ চা বা ভেষজ পাণীয় হজম শক্তি বাড়ায়, শরীরের টক্সিন দূর করে ও প্রদাহ কমায়।

কোষ্ঠকাঠিন্য কোন রোগ নয়, এটি আসলে শরীরের ভেতরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার লক্ষণ। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সঠিক খাদ্য ও কিছু ঘরোয়া উপায় মেনে চললেই এই সমস্যা সম্পূর্ণভাবে দূর করা সম্ভব। মনে রাখবেন, সুস্থ পেট মানে সুস্থ শরীর ও শান্ত মন। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেশি জটিল হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

MedicalNewsToday, Cleveland Clinic, Johns Hopkins Medicine, WebMd