Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাখাদ্য ও পানীয় Food & Drinksরোগ ও ব্যাধি Health Condition

গিলান ব্যারি সিনড্রোম: রোগ লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা। Guillain-Barre Syndrome: Symptoms, Causes & Treatment.

গিলান ব্যারি সিনড্রোম হল এমন একটি বিরল স্নায়ু রোগ, যেখানে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুল করে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র কে আক্রমণ করে। প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্যে আমাদের মস্তিষ্ক সারা দেহের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। এই রোগের আক্রমণে আমাদের পা, ধর, বাহু এবং মুখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ফলে পক্ষাঘাত দেখা দেয়।

এই প্রতিবেদনে গিলান ব্যারি সিনড্রোম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

গিলান ব্যারি সিনড্রোম হল একটি বিরল অটোইমিউন রোগ যা আমাদের প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র কে অকেজো করে তোলে। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতিকর জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে। কিন্তু গিলান ব্যারি সিনড্রোম-এর ক্ষেত্রে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করতে গিয়ে অতি সক্রিয় হয়ে ভুল করে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র কে আক্রমণ করে।

মায়োলিন নামক পদার্থ স্নায়ুর আবরণ তৈরি করে। এছাড়া মায়োলিন আবরণী বার্তা পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গিলান ব্যারি সিনড্রোম হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম স্নায়ুর এই মায়োলিন আবরণীর ক্ষতি করে। এরফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুগুলি স্পাইনাল কর্ড ও মস্তিষ্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠাতে পারে না। একারণে অসারতা অনুভব হয় ও পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই রোগ হঠাৎ করে শুরু হয় এবং কয়েক ঘণ্টা, দিন বা সপ্তাহের মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করে।

এই রোগ প্রাথমিকভাবে পায়ের অসারতা এবং পায়ের দুর্বলতা দিয়ে শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের মধ্যে ধর এবং বাহুতে এই সমস্যা ছড়িয়ে পড়ে। দেহের সকল অংশে, সামনে ও পিছনে সমানভাবে প্রভাব পড়ে। দুর্বলতা শুরু হওয়ার আগে অনেক সময় অস্বাভাবিক সংবেদন যেমন পা ঝিনঝিন করা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যেতে পারে। অনেক সময় মুখ, মূত্রাশয়, গলবিল ইত্যাদির পেশীও প্রভাবিত হয়, ফলে চিবিয়ে খেতে ও গিলতে অসুবিধা হয়।

বেশ কয়েক প্রকার গিলান ব্যারি সিনড্রোম আছে। অ্যাকিউট ইনফ্লামেটরি ডিমাইলিনেটিং পলিরাডিকুলোনিউরোপ্যাথি নামক রোগে দুর্বলতা শরীরের নিচের দিকে শুরু হয় এবং উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। মিলার ফিসার সিনড্রোম-এর ক্ষেত্রে প্রথমে চোখ নাড়াতে সমস্যা হয় এবং পরবর্তীকালে দেহের ভারসাম্য নষ্ট হয়। অ্যাকিউট ডিসঅটোনোমিয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ ব্যাহত হওয়া ও হজমের সমস্যা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।

সাধারণত কোন একটি জীবাণুর সংক্রমণের পরে গিলান ব্যারি সিনড্রোম দেখা দেয়। জীবাণুর সংক্রমণের পর মাত্র কয়েকজনের দেহে গিলান ব্যারি সিনড্রোম দেখা যায় এবং অন্যদের তেমন কিছু হয় না। অসুস্থতার এক থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে গিলান ব্যারি সিনড্রোমের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়। কেন এমন হয় এটা সম্পর্কে গবেষণায় এখনও পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীদের মতে এটি একটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমের সমস্যা জনিত রোগ। কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে, অসুস্থ হওয়ার পর তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অস্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। এর ফলে প্রান্তীয় স্নায়ুগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও গিলান ব্যারি সিনড্রোম দেখা দেয়। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্যা জীবনব্যাপী স্থায়ী হয় না।

গবেষকেরা গিলান ব্যারি সিনড্রোমের কারণ হিসেবে বিশেষ ধরনের কিছু জীবাণুর সংক্রমণ ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত কারণ খুঁজে পেয়েছেন। ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী জীবাণু ক্যাম্পাইলোব্যক্টর জেজুনি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর বা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের পর গিলান ব্যারি সিনড্রোম দেখা গিয়েছে। কিছু ভাইরাসের সংক্রমণের পর যেমন ফ্লু সৃষ্টিকারী সাইটোমেগালোভাইরাস, এপস্টাইন বার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস ইত্যাদির সংক্রমণের পর গিলান ব্যারি সিনড্রোম হতে পারে। এছাড়া ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও এই সমস্যা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ফ্লুর বিরুদ্ধে টিকা নেওয়ার পরে গিলান ব্যারি সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। খুব কম ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের পর গিলান ব্যারি সিনড্রোম হতে পারে।

অন্যান্য স্নায়ু রোগের সাথে গিলান ব্যারি সিনড্রোমের উপসর্গগুলির যথেষ্ট মিল আছে। তাই আপনার চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করার জন্য রোগের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো করে জানবেন। কিভাবে লক্ষণগুলি শুরু হয়েছে, কখন শুরু হয়েছে, সাম্প্রতিককালে অসুস্থ হয়েছেন কিনা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। এছাড়া আপনার চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা করবেন, স্নায়ুর কার্যকলাপ পরীক্ষা করবেন, পেশির শক্তি ও দেহের ভারসাম্য পরীক্ষা করবেন। এই রোগ সম্পর্কে ধারণা পেতে সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে প্রোটিনের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। পেশির কার্যকলাপ পরিমাপ করার জন্য ইলেকট্রোমিওগ্রাফি করা হয়। এছাড়া প্রয়োজনে স্নায়ুর পরিবাহিতা পরিমাপ করা হয় এবং স্পাইনাল কর্ড ও মস্তিষ্কের এম আর আই করতে হতে পারে।

এই গিলান ব্যারি সিনড্রোম রোগ একটি জরুরি অবস্থা, একারণে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা করা দরকার। শ্বাসকষ্ট ও রক্তচাপ ওঠানামার উপর নজর রাখতে হয়। এই রোগের কোন পরিচিত প্রতিকার নেই। তবে রোগের লক্ষণ অনুসারে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রধানত দুই ধরনের থেরাপি ব্যবহার করে গিলান ব্যারি সিনড্রোমের জটিলতা কমানোর চেষ্টা করা হয়। প্লাজমাফেরোসিস নামক চিকিৎসার সাহায্যে ক্ষতিকর নার্ভ ধ্বংসকারী অ্যান্টিবডিগুলিকে একটি মেশিনের সাহায্যে প্লাজমা থেকে আলাদা করা হয় ও পরিশুদ্ধ প্লাজমা আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ইন্ট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবিউলিন থেরাপির সাহায্যে শরীরে বিশেষ ধরনের প্রোটিনকে প্রবেশ করানো হয়। এই দুই প্রকার চিকিৎসা গ্রহণ করলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

গিলান ব্যারি সিনড্রোম থেকে পক্ষাঘাত দেখা দিলে সেটা বেশ জটিল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র অর্থাৎ ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয়। রক্ত জমাট বাধার সমস্যা হলে আন্টিকুয়াগুলেন্ট ইনজেকশন দিতে হয়। এছাড়া খাবার খাওয়ানোর জন্য ন্যাসোগ্যাস্ট্রিক টিউব ব্যবহার করা হয়।

গিলান ব্যারি সিনড্রোম থেকে সেরে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। নার্ভের কার্যকলাপ উন্নত করতে এবং পেশির শক্তি বৃদ্ধি করতে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হয়। দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য অকুপেশনাল থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়। স্পিচথেরাপির সাহায্যে আবার কথা বলা সম্ভব হয়। এছাড়া ওয়াকার, হুইলচেয়ার ইত্যাদি ব্যবহার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে হয়।

Mayo Clinic, Cleveland Clinic, MedicalNewsToday, WebMd e.t.c.