ইমিউনিটি কি? ইমিউনিটি কিভাবে কাজ করে? What is Immunity? How does immunity work?
ইমিউনিটি কি? What is Immunity?
আমাদের চারিপাশে প্রচুর পরিমাণে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু অর্থাৎ প্যাথোজেন বসবাস করে। প্রতিনিয়ত এই সকল রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর দ্বারা আমরা আক্রান্ত হই। এই সকল রোগ সৃষ্টিকারী পরজীবীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে, আমাদের দেহে বিশেষ ধরনের ব্যবস্থাপনা আছে। এই বিশেষ ব্যবস্থাপনা বা তন্ত্রকে অনাক্রম্যতন্ত্র বা ইমিউনিটি বলে।
কিভাবে আমাদের শরীর, রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কিভাবে রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করে, সেটা জানতে প্রতিবেদনটি পড়তে থাকুন।
অনাক্রম্যতা বা বা ইমিউনিটি: Immunity:
রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের সনাক্তকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষমতাকে বলা হয় অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি। অচেনা কোন দুর্বৃত্ত হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এসে ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আমরা যেমন প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি, ঠিক তেমনি, বাইরের কোন জীবাণু বা বিজাতীয় বস্তু, যেমন ফুলের রেণু, বিষ বা টক্সিন তথা অ্যান্টিজেন, আমাদের দেহে প্রবেশ করলে আমাদের দেহও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটাই হল অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি।
অনাক্রম্যতার প্রকারভেদ: Types of Immunity:
অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি প্রথমত দুই প্রকার:-
(1)সহজাত অনাক্রম্যতা এবং (2)অর্জিত অনাক্রম্যতা।
সহজাত অনাক্রম্যতা Innate Immunity:
এই প্রকার অনাক্রম্যতা আমরা বংশগতভাবে আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পায়। এটা অনির্দিষ্ট অর্থাৎ সব জীবনের বিরুদ্ধেই কম-বেশি কাজ করে। বাইরে থেকে রোগ জীবাণু দেহে প্রবেশ করতে গেলে তার বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ করে। এই ইমিউনিটি সারা জীবন ধরে কার্যকর থাকে। আমাদের দেহত্বক, শ্লেষ্মা পর্দা ইত্যাদি জীবাণুর প্রবেশে বাধা দেয়। আবার পাকস্থলীর মধ্যে থাকা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, দেহ-তরলের মধ্যে থাকা লাইসোজোম, জীবাণুকে রাসায়নিকভাবে ধ্বংস করে ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
অর্জিত অনাক্রম্যতা: Acquired Immunity:
সহজাত ইমিউনিটি বাধা দেওয়া সত্ত্বেও, কিছু রোগ জীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করে। এই সকল জীবাণুর বিরুদ্ধে আমাদের দেহ, যে নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাকে অর্জিত অনাক্রম্যতা বলে। এক্ষেত্রে, জীবাণুটিকে নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করে ধ্বংস করা হয়। এই ইমিউনিটি জীবাণুর প্রবেশে বাধা দেয় না, কিন্তু জীবাণুটি প্রবেশ করলে তাকে ধ্বংস করে।
দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশ করলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম উদ্দীপিত হয় এবং বিশেষ ধরনের অ্যান্টিবডি অর্থাৎ প্রোটিন-ধর্মী রোগ প্রতিরোধকারী পদার্থ উৎপন্ন করে এবং রোগের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। যেমন একবার বসন্ত হলে আর হয় না। আবার টিকা বা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেও কৃত্রিমভাবে দেহে ইমিউনিটি গড়ে তোলা যায়। যেমন পোলিও টিকার সাহায্যে শরীরে অ্যান্টিবডি উৎপাদনের মাধ্যমে পোলিও রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
অনেক সময় বাইরে থেকে দেহে অ্যাণ্টিবডি প্রবেশ করানো হয়। যেমন ঘোড়ার দেহে টিটেনাসের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটিয়ে, অ্যাণ্টি টিটেনাস সিরাম উৎপাদন করা হয় এবং ঘোড়ার দেহে উৎপন্ন অ্যান্টিবডি মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হয়। আবার প্রাকৃতিক ভাবেও এরকম ঘটনা ঘটে। মায়ের দেহে উৎপন্ন জীবাণু ধ্বংসকারী অ্যান্টিবডি, প্লাসেণ্টার মাধ্যমে ভ্রূণে প্রবেশ করে এবং জন্মের পর মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় শিশু, স্তন পানের মাধ্যমে অ্যাণ্টিবডি গ্রহণ করে এবং রোগের হাত থেকে রক্ষা পায়।
ইমিউন রেসপন্সের প্রাথমিক ধারণা: Primary Concept of Immune Response:
যে সব বহিরাগত প্যাথোজেন বা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, আমাদের দেহে প্রবেশ করে, তাদের অ্যান্টিজেন বলা হয়। এই অ্যান্টিজেন অর্থাৎ রোগ জীবাণুকে ধ্বংস করে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা অনাক্রম্যতা তন্ত্র। আমাদের এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রধানত দুভাবে রেসপন্স করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায়; রস নির্ভর এবং কোষ নির্ভর।
রস নির্ভর ইমিউন সিস্টেম: Humoral Immune Response:
রস নির্ভর ইমিউন সিস্টেম দেহ-তরলের মাধ্যমে কাজ করে। রক্তে উপস্থিত B লিম্ফোসাইট এই কাজ করে। অস্থিমজ্জা থেকে এই B উৎপন্ন হয় এবং সেখানেই পূর্ণতা লাভ করে।
B লিম্ফোসাইট দু প্রকার:
প্লাজমা কোশ:এই কোশ অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে।
স্মৃতি বা মেমোরি কোশ: এই কোষ রোগ জীবাণু অর্থাৎ আণ্টিজেনের গঠন মনে রাখে এবং ভবিষ্যতে ওই একই রোগজীবাণু আক্রমণ করলে এরা জীবাণুকে তাড়াতাড়ি চিহ্নিত করতে পারে এবং অ্যাণ্টিবডি উৎপাদন করে ধ্বংস করে অর্থাৎ এরা ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেয়।
কোশ নির্ভর ইমিউন সিস্টেম: Cell-mediated Immune Response:
কোশ নির্ভার ইমিউন সিস্টেম কাজ করে, ইমিউন সিস্টেমের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কোশের সাহায্যে। এক্ষেত্রে প্রধানত T লিম্ফোসাইট অংশ নেয়। T লিম্ফোসাইট সরাসরি রোগ জীবাণুকে বা অ্যান্টিজেনকে আক্রমণ করে এবং ইমিউন রেসপন্স নিয়ন্ত্রণ করে।
T লিম্ফোসাইট চার প্রকার:
i) সাইটোটক্সিক T কোশ,
ii) হেল্পার T কোশ,
iii) সাপ্রেশর T কোশ,
iv) মেমরি T কোশ
T লিম্ফোসাইট এবং B লিফোসাইট এক যোগে কাজ করে রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এটি দুভাবে কাজ করে:
প্রাথমিক ইমিউন রেসপন্স: Primary Immune Response:
রোগ জীবাণু বা অ্যান্টিজেন দেহে প্রবেশের সাথে সাথে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সেটা হল প্রাথমিক ইমিউন রেসপন্স। প্রথমে দেহের মধ্যে থাকা ম্যাক্রোফাজ কোশগুলি জীবাণুগুলিকে খেয়ে ফেলে। এরপর এরা নিজ কোশে অ্যান্টিজেনকে প্রকাশ করে। হেল্পার T কোশ এই অ্যান্টিজেনকে সনাক্ত করে তার সাথে আবদ্ধ হয়। হেল্পার T কোশ তখন সাইটোটক্সিক T কোশ ও B কোশকে সক্রিয় করে। এই সক্রিয় B কোশ, প্লাজমা কোশ ও মেমোরি কোশ তৈরি করে। প্লাজমা কোশ অ্যাণ্টিবডি উৎপাদন করে এবং এই অ্যান্টিবডি জীবাণুকে ধ্বংস করে। সাইটোটক্সিক T কোশ, জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত দেহকোশগুলিকে সরাসরি ধ্বংস করে এবং কোশের মধ্যে থাকা জীবাণু গুলিও ধ্বংস হয়।
প্রাথমিক ইমিউন রেসপন্স দুর্বল প্রকৃতির এবং ধীরে কাজ করে।
গৌণ ইমিউন রেসপন্স
রোগ জীবাণু অর্থাৎ অ্যান্টিজেন দ্বিতীয়বার দেহকে আক্রমণ করলে, মেমোরি B কোশগুলি তাদের স্মৃতিতে থাকা আণ্টিজেনের গঠন থেকে পুনরায় অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে এবং জীবাণুকে ধ্বংস করে। এটি দ্রুত ঘটে এবং এই ইমিউন রেসপন্স বেশ শক্তিশালী। এই কাজে মেমরি T কোশ সাহায্য করে। চিকেন পক্স, মিসল্ ইত্যাদি রোগ সাধারণত একবার হলে আর হয় না; এই গৌণ ইমিউন রেসপন্সর কারণে।