ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট: Creatinine Clearance Test:
ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করে আমরা জানতে পারি, আমাদের বৃক্ক বা কিডনি কতটা ভাল কাজ করছে বা কতটা সুস্থ আছে। কখন, কেন এবং কিভাবে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা হয়, সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এছাড়া ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্টের ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ক্রিয়েটিনিন হল আমাদের শরীরে উৎপন্ন হওয়া বিপাক জাত দূষিত পদার্থ। আমাদের দেহকোষ ও মাংস পেশী প্রোটিন জাতীয় খাদ্য ব্যবহার করার ফলে এই ক্রিয়েটিনিন উৎপন্ন হয়। বৃক্ক অর্থাৎ কিডনি এই ক্রিয়েটিনিন নামক দূষিত পদার্থকে শরীরের বাইরে নির্গত করে। এটি মূত্রের মাধ্যমে নির্গত হয়।
এই ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্টের মাধ্যমে, আমাদের কিডনি অর্থাৎ বৃক্কের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। আমাদের কিডনি প্রতি মিনিটে আমাদের রক্ত ছেঁকে পরিষ্কার করে। কিডনি কতটা পরিমাণ রক্ত পরিষ্কার করছে সেটা বোঝা যায় গ্লোমারুলার ফিল্ট্রেশন রেট দেখে। অর্থাৎ কিডনির মধ্যে অবস্থিত গ্লোমারুলাস নামক ছাঁকনির মধ্য দিয়ে কতটা রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, সেটা দেখে বৃক্ক বা কিডনির স্বাস্থ্য সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট এই গ্লোমারুলার ফিল্ট্রেশন রেট নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
বৃক্ক বা কিডনির মধ্যে রক্তের প্রবাহ কমে গিয়েছে কিনা সেটা জানতে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা হয়। কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর-এর ক্ষেত্রে এই টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাভাবিক ও সুস্থ বৃক্ক কিভাবে কাজ করে? How does a normal and healthy kidney work?
আমাদের দেহের সকল রক্ত কিডনির মধ্য দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশো বার প্রবাহিত হয়। কিডনির মধ্যে নেফ্রন নামক ছাঁকনির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সময়, রক্তের মধ্যে থাকা বিপাক জাত বর্জ্য পদার্থ আলাদা হয়ে যায়। প্রয়োজন অতিরিক্ত জলও বৃক্কের মাধ্যমে দেহের বাইরে নির্গত হয়। এই প্রয়োজন অতিরিক্ত জল ও বিপাক জাত বর্জ্য একত্রে মূত্র উৎপাদন করে এবং শরীরের বাইরে নির্গত হয়।
ক্রিয়েটিনিন এবং ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স বলতে কী বোঝায়? What is Creatinine and Creatinine Clearance?
আমাদের দেহ কোষ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য উপাদান ব্যবহার করলে এবং কোষ ও মাংসপেশি ধ্বংস হওয়ার ফলে দেহে ক্রিয়েটিনিন নামক বিপাক জাত দূষিত পদার্থ উৎপন্ন হয়। এই ক্রিয়েটিনিন রক্তের মাধ্যমে কিডনিতে পৌঁছায় এবং কিডনি মূত্রের মাধ্যমে ক্রিয়েটিনিনকে শরীরের বাইরে নির্গত করে।
যে পরিমাণ রক্তকে আমাদের বৃক্ক প্রতি মিনিটে ক্রিয়েটিনিন মুক্ত করতে পারে, তাকে ক্রিয়েটেনিন ক্লিয়ারেন্স বলা হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক পুরুষের ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স হল 120 মিলিলিটার প্রতি মিনিট। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মহিলার ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স হল 95 মিলিলিটার প্রতি মিনিট। অর্থাৎ কিডনি বা বৃক্ক প্রতি মিনিটে একজন পুরুষের 120 মিলিলিটার রক্ত এবং একজন মহিলার 95 মিলিলিটার রক্ত ক্রিয়েটিনিন মুক্ত করতে পারে।
কখন ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা হয়? When is the creatinine clearance test done?
একজন ব্যক্তির বৃক্ক বা কিডনি কতটা পরিমাণ রক্ত পরিশুদ্ধ করছে এবং কিডনির স্বাস্থ্য কেমন আছে সেটা জানতে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করতে দেওয়া হয়। কোন ব্যক্তির রক্তে ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেশি থাকলে বা মূত্রের মধ্য দিয়ে প্রোটিন নির্গত হলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করতে দেওয়া হয়।
বৃক্ক রোগাক্রান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলে, যেমন হাত-পা ফুলে গেলে, বিশেষভাবে মুখমণ্ডল ফুলে গেলে, হাতের কব্জি, পেট, থাই, গোড়ালি ইত্যাদি স্থান ফুলে উঠলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করতে বলা হয়।
মূত্রের পরিমাণ কম হলে, মূত্রের রং ঘন হলে, মূত্রের রং কফির মত বাদামী হলে, মূত্রের মধ্যে ফেনা হলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা প্রয়োজন। মূত্র ত্যাগ করতে সমস্যা হলে, মূত্রত্যাগের সময় জ্বালা হলে, বারবার মূত্র ত্যাগ হলে, অবশ্যই ক্রিয়েটনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা প্রয়োজন। মূত্রের মধ্য দিয়ে রক্ত নির্গত হলেও এই টেস্ট করা উচিত।
পিঠে ও কোমরে বা যে স্থানে কিডনি থাকে সেখানে ব্যথা হলে, সঙ্গে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা উচিত।
কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর নামক রোগে বা অন্য কোন কারণে বৃক্কের মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহের পরিমাণ কমে গেলে এই টেস্ট করা প্রয়োজন। যারা কিডনির রোগে ভুগছেন বা কিডনি রোগের চিকিৎসা করাচ্ছেন, তাদেরও নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা প্রয়োজন।
ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষার আগের প্রস্তুতি ও নমুনা সংগ্রহ: Creatinine Test Preparation and Specimen Collection:
এই পরীক্ষা করার আগে 10 থেকে 12 ঘণ্টা কোন খাদ্য গ্রহণ করা চলে না। কেবলমাত্র জল পান করা যেতে পারে। যে ধরনের খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করা হয়, ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করার আগের দিন সেই রকম খাদ্যই গ্রহণ করা উচিত। খাদ্য তালিকায় বিশেষ কোন পরিবর্তন করা উচিত নয়। সারারাত উপবাস করার পর সকালে রক্তের নমুনা দিতে হবে। পরীক্ষার আগের দিন মাংস খাওয়া চলবে না।
ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করার জন্য মূত্রের নমুনাও প্রয়োজন হতে পারে। গত 24 ঘণ্টায় ত্যাগ করার সমস্ত মূত্র একটি পরিষ্কার ঢাকনা যুক্ত পাত্রের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে। যেদিন পরীক্ষা করা হবে তার আগের দিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সমস্ত মূত্র প্রথমে ত্যাগ করতে হবে। এরপর সারাদিন যতবার মূত্র ত্যাগ হবে, সকল মূত্র একটি পরিষ্কার পাত্রে সংগ্রহ করতে হবে। পরীক্ষার দিন সকালে প্রথম ত্যাগ করা মূত্রও পাত্রের মধ্যে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরিকে পাঠাতে হবে। 24 ঘণ্টা ধরে সংগ্রহ করা মূত্র যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, তার জন্য সংগ্রহ করা মূত্রের পাত্রটিকে রেফ্রিজারেটরের ভিতরে রাখতে হবে।
আপনার চিকিৎসক প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ করার পরও টেস্ট করতে বলতে পারেন। বিশেষ কিছু ওষুধ যেমন ব্যকট্রিম নামক অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টাসিড যেমন ফেমিটিডিন, ইত্যাদি ওষুধ ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করার আগে বন্ধ করতে বলতে পারেন। পরীক্ষার আগে কি কি ওষুধ গ্রহণ করেছেন, সেটা ল্যাবরেটরি ও আপনার চিকিৎসককে জানান।
সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আঙুলে সূচ বিদ্ধ করে রক্ত সংগ্রহ করা হয় না। তবে বর্তমানে বিশেষ কিছু পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছে, যেখানে আঙুলে সূচ বিদ্ধ করে রক্ত সংগ্রহ করে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা হয়। এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি পরীক্ষার ফলাফল জানা সম্ভব হয়। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে রক্তের সিরাম থেকে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করা বেশি ভাল।
ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা: Interpretation of creatinine test results:
ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স কম হলে বা গ্লোমারুলার ফিল্ট্রেশন রেট কম হলে বুঝতে হবে যে, কিডনি বা বৃক্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। কিডনির রোগ ধীরে ধীরে হতে পারে বা হঠাৎ করে হতে পারে। একাধিকবার ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স টেস্ট করলে কিডনির কিরকম হারে ক্ষতি হয়েছে সেটা বোঝা যায়।
কিডনি বা বৃক্কের কার্যকারিতা বয়সের সাথে সাথে কমতে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বৃক্কের সক্ষমতা প্রয়োজনের থেকে অনেকটা বেশি থাকে। বৃক্কের কার্যকারিতা 30 থেকে 40 শতাংশ কমে গেলেও আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয় না।
বৃক্কের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়া বা বৃক্ক রোগগ্রস্ত হওয়াকে সাধারণত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
স্টেজ-1: GFR 90 বা তার বেশি থাকে। | এক্ষেত্রে বৃক্কের কার্যকারিতা 90% এর বেশি থাকে বা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকে। |
স্টেজ-2: GFR 60 থেকে 89 হলে, | বৃক্কের কার্যকারিতা সামান্য হ্রাস পায়। |
স্টেজ-3a: GFR 45 থেকে 59 হলে, | বৃক্ক মাঝারি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত এটা বোঝা যায়। |
স্টেজ-3b: GFR 30 থেকে 44 এর মধ্যে হলে, | মাঝারি থেকে বেশি মাত্রায় বৃক্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। |
স্টেজ-4: GFR 15 থেকে 29 হলে, | কিডনি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। |
স্টেজ-5: GFR 15 এর কম হলে বুঝতে হবে, | বৃক্ক কাজ করা বন্ধ করেছে। কিডনি ফেলিওর হয়েছে। এখন ডায়ালিসিস প্রয়োজন। |
কিডনি রোগগ্রস্ত হলে, কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পেলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স এর মান কম হয়। কিডনি বা বৃক্কের কার্যকারিতা কমার বিভিন্ন কারণ হতে পারে। কিডনির মধ্যে থাকা রক্তনালীগুলি ফুলে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ইনফেকশন হলে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পায়। বৃক্কের একক হল নেফ্রন। এই নেফ্রন বিষক্রিয়ার কারণে বা কোন ওষুধে বিষক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে, প্রস্টেট রোগগ্রস্ত হলে, কিডনিতে স্টোন হলে, মূত্রনালিতে বাধার সৃষ্টি হলে বৃক্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। ইলেকট্রিক শক লাগলে, আঘাত পেলে, ডিহাইড্রেশন অর্থাৎ শরীরে জলের অভাব ঘটলে, কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর হলে, ডায়াবেটিস থেকে কোন সমস্যার সৃষ্টি হলে বৃক্কের কাজ করার ক্ষমতা হাস পায়।
ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট বেশিও হতে পারে। গর্ভবতী মায়েদের ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্সের হার বেশি হয়। এছাড়া ব্যায়াম করলে, বেশি প্রোটিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট বেশি হয়।
মন্তব্য Remarks
কিডনি রোগে সব থেকে বড় সমস্যা হল, একটি কিডনির ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্য আরেকটি সুস্থ কিডনি অতিরিক্ত কাজ করে দেয়। ফলে শরীরে ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স এর মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। আর এই কারণে, বৃক্কের রোগ সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন হওয়া সম্ভব হয় না।