তরমুজ খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা: Surprising Health Benefits of Watermelon:
তরমুজ হল একটি গ্রীষ্মকালীন সুস্বাদু মিষ্টি ফল যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ভাল। তরমুজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে জল ও সুগার থাকার সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি উপাদান থাকে।
এই প্রতিবেদনে তরমুজ খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সব শেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বোনাস টিপস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
তরমুজের পুষ্টিগুণ: Watermelon Nutrition:
এক কাপ অর্থাৎ প্রায় 250 গ্রাম তরমুজের মধ্যে প্রায় 46 ক্যালরি শক্তি থাকে। প্রোটিন থাকে 0.9 গ্রাম, ফ্যাট থাকে 0.2 গ্রাম এবং কার্বোহাইড্রেট থাকে 11.5 গ্রাম। এছাড়া থাকে 0.6 গ্রাম ফাইবার ও 9.4 গ্রাম সুগার। তরমুজে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন C ও ভিটামিন A থাকে। এছাড়া ক্যান্সার প্রতিরোধকারী লাইকোপিন (Lycopene) ও রক্ত সঞ্চালনে সাহায্যকারী সিট্রুলিন (Citrulline) থাকে তরমুজের মধ্যে।
তরমুজের খোসা বীজের ও পুষ্টিগুণ: Watermelon Seeds and Rinds Nutrition:
তরমুজের বীজ এবং খোসা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার আগে একবার চিন্তা করা দরকার। তরমুজের খোসার মধ্যে সুগারের পরিমাণ কম থাকে এবং ফাইবার বেশি থাকে। এছাড়া থাকে থাকে সিট্রুলিন যা ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তরমুজের বীজের মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম, ফলেট ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান থাকে।
এছাড়া তরমুজের খোসা ও বীজে থাকে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল LDL এর মাত্রা কমায়। অর্থাৎ তরমুজের বীজ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।
তরমুজের উপকারিতা: Health Benefits of Watermelon:
দেহে জলের ভারসাম্য রক্ষা করে: Helps to Stay Hydrated:
দেহে জলের অভাব হওয়ার একটি বিপদজনক বিষয়। জলের অভাব হলে ক্লান্তি, অবসাদ, পেশীর খিচুনি, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। তরমুজে প্রায় 92% জল থাকে, তাই এটি আমাদের শরীরে জলের চাহিদা মেটাতে পারে। শারীরিক কসরতের পর লবণ ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা পূরণ করার জন্য সামান্য লবণ ছিটিয়ে তরমুজ খাওয়া যেতে পারে। এটা আমাদের শক্তি পুনরুদ্ধার করতে দারুণ কাজ করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: Helps Manage Weight:
ওজন বৃদ্ধিকারী উচ্চ ক্যালরি-যুক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবারের বদলে তরমুজ খাওয়া যেতে পারে। এটা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে। কারণ তরমুজে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে এবং অল্প পরিমাণে ক্যালরি থাকে। 2019 সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যে সকল স্থূল ব্যক্তি কুকিজের বদলে তরমুজ খেয়েছেন, তাদের ওজন কমেছে। এছাড়া তরমুজ খেলে পেট ভরে থাকার অনুভূতি হয় এবং খিদে কম পায়।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: Have Anti – Cancer Effect:
তরমুজের মধ্যে পাওয়া যায় লাইকোপিন (Lycopene) এবং কিউকারবিটাসিন (Cucurbitacin)। এই জৈব যৌগগুলি ক্যান্সার প্রতিরোধের সাহায্য করে। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, লাইকোপিন বেশ কয়েক ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। আমাদের দেহে ইনসুলিন লাইক গ্রোথ ফ্যাক্টর (Insulin – like Growth Factor) নামক একটি হরমোনের থাকে যা কোষ বিভাজনকে উৎসাহিত করে। অনিয়ন্ত্রণ কোষ বিভাজনের কারণেই ক্যান্সার হয়। লাইকোপিন এই কোষ বিভাজনে উৎসাহ দানকারী হরমোনটির কাজে বাধা দিয়ে ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে। আবার, কিউকারবিটাসিন নামক রাসায়নিক যৌগটি দেহের ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
রোগ থেকে রক্ষা করে: Protects Against Disease:
নিয়মিত তরমুজ খেলে, সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, স্থূলতা, হার্টের রোগ ইত্যাদি কমে। কারণ তরমুজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং কোষের ক্ষতি রোধ করে।
টমেটো সহ অন্যান্য ফল ও শাকসবজির থেকে তরমুজে বেশি পরিমাণে লাইকোপিন থাকে। এছাড়া অ্যামাইনো অ্যাসিড সিট্রুলিন থাকে তরমুজের মধ্যে। এই সিট্রুলিন (Citrulline), নাইট্রিক অক্সাইড (Nitric Oxide) উৎপাদনে সাহায্য করে। এই নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালী প্রসারিত করে এবং রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। এরফলে রক্তচাপ কমে, হার্টের রোগ ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা কমে।
চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে: Support Eye Health:
চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে তরমুজ খুব উপকারী। তরমুজে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট করতে ছানি পড়তে বাধা দেয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, চোখের রোগ ম্যাকুলার ডিজেনারেশন-এর হাত থেকে রক্ষা করে তরমুজে থাকা লাইকোপিন নামক উপাদান। এছাড়া তরমুজে থাকে ভিটামিন A, যা চোখের কর্নিয়ার স্বাস্থ্য রক্ষা করে। তরমুজের একটি মাঝারি টুকরো ভিটামিন A-র অভাব মেটাতে পারে।
ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করে:Aids Skin Health:
তরমুজের মধ্যে ভিটামিন C থাকে যা শরীরে কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। কোলাজেন আমাদের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় এবং ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে। এছাড়া কোলাজেন আমাদের হাড়ের জয়েন্টগুলিকে সুস্থ রাখে। তরমুজে থাকা বিটা ক্যারোটিন (Beta-Carotene) ভিটামিন A উৎপাদনে সাহায্য করে। ভিটামিন A ত্বকের কোষগুলির স্বাস্থ্য রক্ষা করে, শুষ্ক ত্বক, ফাটা ত্বক ইত্যাদি সমস্যা দূর করে। এছাড়া তরমুজে থাকা ভিটামিন B6 ব্রণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। তাই উজ্জ্বল সুন্দর ত্বক পেতে হলে, অবশ্যই তরমুজ গ্রহণ করতে হবে।
হজম শক্তির উন্নতি ঘটায়: Improves Digestion:
তরমুজে প্রচুর পরিমাণ জল ও ফাইবার থাকার কারণে তরমুজ পৌষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে খাদ্য হজমে সাহায্য করতে পারে। ফাইবার একটি অপাচ্য কার্বোহাইড্রেট জাতীয় পদার্থ, যা কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। তরমুজে থাকা পলিফেনল আমাদের অন্ত্রে বসবাসকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়। এর ফলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম উন্নত হয় এবং আমরা সুস্থ থাকি।
পেশির ব্যথা উপশম করে: Relieves Muscle Soreness:
তরমুজে থাকা সিট্রুলিন আমাদের পেশির সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ব্যায়াম বা পরিশ্রমের ফলে পেশির মধ্যে উৎপন্ন হওয়া ল্যাকটিক অ্যাসিড দূর করে সিট্রুলিন পেশির ব্যথা কমায়। সিট্রুলিন রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ও নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে সাহায্য করে। এর ফলে হার্ট, রক্তনালী ও পেশির স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
বোনাস টিপস: তরমুজ হল ন্যাচারাল ভায়াগ্রা: Watermelon is Natural Viagra:
ভায়াগ্রা নামক ওষুধ যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে অসাধারণ কাজ করে। লিঙ্গ শিথিলতা অর্থাৎ ইরেকটাইল ডিসফাংশানের (Erectile Dysfunction) চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটিয়েছে এই ভায়াগ্রা। তবে এই ওষুধ সবার ক্ষেত্রে সমান কাজ করে না, বেশ কিছু ক্ষেত্রে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আর এখানেই তরমুজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে তরমুজে থাকা সিট্রুলিন নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদনে সাহায্য করে। এই নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালী প্রসারিত করে লিঙ্গে রক্তের প্রবাহ বাড়ায় এবং লিঙ্গ শিথিলতা দূর হয়।
তরমুজ খাওয়ার নিয়ম: Rules for Eating Watermelon:
কখন তরমুজ খাবেন সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সন্ধ্যের পর বা রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তরমুজ খাওয়া উচিত নয়। রাত্রে তরমুজ খেলে হজমের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় ও পেটের বিভিন্ন সমস্যার সূচনা হতে পারে। তরমুজে প্রচুর ন্যাচারাল সুগার থাকার কারণে রাত্রে তরমুজ খেলে বারে বারে টয়লেটে যেতে হতে পারে। এর ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং পেটে গ্যাস অম্বল, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ভারতীয় আয়ুর্বেদের মতে তরমুজ খাওয়ার সঠিক সময় সকাল বা বিকেল, কিন্তু বিকেলের পরে নয়। তরমুজ খাওয়ার সেরা সময় হল বেলা 12 টা থেকে 1 টা। এই সময় হজমের হার বেশি থাকে ও পৌষ্টিকতন্ত্র সক্রিয় থাকে।
তরমুজ খাওয়ার আগে তরমুজকে কিছুক্ষণ জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তরমুজ কেনার সাথে সাথে খেতে হবে, সংরক্ষণ করে রাখা উচিত নয়। তরমুজের জুসের বদলে সম্পূর্ণ তরমুজ খাওয়া বেশি ভাল।
তরমুজের বীজ ফেলে দেওয়া উচিত নয়। কুমড়ো বীজের মত তরমুজের বীজ পুষ্টি উপাদানের ভাণ্ডার। তাই বীজ সহ তরমুজ খেয়ে ফেলা বেশ ভাল। শুকনো বা ভাজা বীজ গুড়ো করে রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে।