রক্ত পরীক্ষা Blood Testসংবাদ News

ব্লাড সুগার টেস্ট Blood Sugar Test

ব্লাড সুগার টেস্ট Blood Sugar Test

এই প্রতিবেদনের আলোচনার বিষয়, ব্লাড সুগার টেস্ট। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ হল, রক্তের সুগার পরীক্ষা করা। বিস্তারিত জানতে প্রতিবেদনটি পড়তে থাকুন।

কখন ব্লাড সুগার টেস্ট করা প্রয়োজন? When is blood sugar test necessary?

যদি আপনার ডাক্তার ব্লাড সুগার টেস্ট করার পরামর্শ দেয় সেক্ষেত্রে অবশ্যই আপনি আপনার রক্তের সুগার টেস্ট করবেন। বার্ষিক হেলথ চেকআপ করার সময় রক্তের যে সকল পরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে ব্লাড সুগার টেস্ট অন্যতম। এছাড়া বেশকিছু রোগ লক্ষণ আছে যেগুলি দেখা গেলে অবশ্যই রক্তের শর্করার পরিমাণ করা দরকার। যদি দেখা যায় তৃষ্ণা বেড়ে গিয়েছে এবং খিদে বেড়ে গিয়েছে সেক্ষেত্রে অবশ্যই রক্তের শর্করা পরীক্ষা করতে হবে। ওজন কমে যাচ্ছে, মুখের ভিতর শুকিয়ে যাচ্ছে, স্ক্রিন ড্রাই হয়ে যাচ্ছে, ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে, দৃষ্টি আবছা হচ্ছে অথবা প্রায়দিনই মাথা ব্যথা করছে, এই সকল রোগের লক্ষণগুলো দেখা গেলে আপনি আপনার ব্লাড সুগার টেস্ট অবশ্যই করুন।

কেন রক্তের শর্করা পরীক্ষা করবেন? Why test blood sugar?

ব্লাড সুগার টেস্ট করা হয় আপনার ডায়বেটিস হয়েছে কিনা দেখার জন্য। ডায়াবেটিস প্রধানত দু’রকমের। একটি টাইপ 1 ডায়াবেটিস এবং একটি টাইপ টু ডায়াবেটিস। টাইপ 1 ডায়াবেটিস কে বলা হয় ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস। এটা কম বয়স থেকে দেখা যায়। যদি আপনার অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন ঠিকমত ক্ষরিত না হয়, সেক্ষেত্রে এই ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। এই ধরনের ডায়াবেটিস খুব কম বয়স থেকে দেখা যায় এবং প্রায় প্রতিদিনই ইনসুলিন হরমোন কৃত্রিমভাবে বাইরে থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয়। দ্বিতীয় রকম ডায়াবেটিস হল টাইপ 2 ডায়াবেটিস। এটাকে নন ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবেটিস বলা হয়। এক্ষেত্রে ইনসুলিনের মাত্রা রক্তের মধ্যে ঠিক থাকে। তা সত্ত্বেও আমাদের রক্তের মধ্যে উপস্থিত সুগারের মেটাবলিজম ঠিকমতো ঘটে না সে জন্যই আমাদের ব্লাড সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। এই ধরনের ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা পৃথিবীতে সবথেকে বেশি। এই ধরনের ডায়াবেটিস কে বলা হয় গুপ্ত ঘাতক বা সাইলেন্ট কিলার; কারণ এটি আমাদের অজান্তেই, বেশ কিছু অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে দেয়।

ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার জন্য কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়? What methods are used to test for diabetes?

সাধারণত দুটি পদ্ধতি আমাদের সামনে উপলব্ধ। প্রথমত আপনি আপনার নিকটবর্তী কোন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে গিয়ে টেস্ট করতে পারেন। অথবা আপনার বাড়িতে যদি রক্তের সুগার পরীক্ষা করার পোর্টেবল যন্ত্র থাকে, সেক্ষেত্রে আপনি বাড়িতে পরীক্ষা করতে পারেন।

কোন পরীক্ষা পদ্ধতিটি ভালো এবং কেন? Which test method is better and why?

সবসময়ই ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করা সব থেকে ভালো কারণ, এখানে সম্পূর্ণ রক্ত থেকে রক্ত-শর্করা পরীক্ষা করা হয় না, প্লাজমা থেকে রক্ত-শর্করা পরীক্ষা করা হয়। রক্ত কণিকার মধ্যে অবস্থিত সুগারকে এরমধ্যে মাপা হয় না এবং এটাই সঠিক পদ্ধতি। এছাড়া ল্যাবরেটরি তে যে পদ্ধতিতে টেস্ট করা হয় তার আবার দুটি ভাগ আছে একটি কেমিক্যাল পদ্ধতি এবং একটি উৎসেচক নির্ভর পদ্ধতি। সর্বাপেক্ষা ভালো হল উৎসেচক নির্ভর পদ্ধতি।

বাড়িতে যে পোর্টেবল যন্ত্রের সাহায্যে আমরা সুগার পরিমাপ করি, তার সমস্যা হচ্ছে যে, এই পদ্ধতিতে সাধারণত ক্যাপিলারি রক্ত ব্যবহার করা হয় এবং সেক্ষেত্রে হোল ব্লাড আমরা ব্যবহার করি অর্থাৎ রক্তের প্লাজমা এবং রক্ত কণিকা উভয়ের মধ্যে থাকা সুগারকে এই পদ্ধতিতে পরিমাপ করা হয়। তাই এই পদ্ধতিতে করা টেস্ট রিপোর্ট সম্পূর্ণ সঠিক নাও হতে পারে। ল্যাবরেটরিতে করা পরীক্ষার ফলাফলের সাথে এই টেস্টের ফলাফল সামান্য আলাদা হতে পারে। তাই নিখুঁত এবং সঠিক ব্লাড সুগার পরিমাপ করতে হলে ল্যাবরেটরি তে গিয়ে ভেনাস ব্লাড গ্রহণ করে অর্থাৎ শিরা থেকে রক্ত গ্রহণ করে উৎসেচক পদ্ধতি ব্যবহার করে টেস্ট করা সব থেকে ভাল।

কোন সময়ে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়? At what time is the blood sample collected?

তিনটি সময় আমরা রক্ত গ্রহণ করে থাকি। প্রথমটিকে বলা হয় ফাস্টিং সুগার। 12 থেকে 14 ঘণ্টা অনাহারে থাকার পর সেই রক্তের মধ্যে সুগারের পরিমাণ করাকে বলা হয় ফাস্টিং সুগার টেস্ট। দ্বিতীয়টি হচ্ছে পোস্ট পারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট অর্থাৎ সংক্ষেপে পি পি ব্লাড সুগার টেস্ট। আমরা যে প্রিন্সিপাল মিল গ্রহণ করি অর্থাৎ দুপুরে যে ভারি খাবার গ্রহণ করি, সেই খাবার গ্রহণ করা শেষ হলে, তার ঠিক 2 ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার পরিমাণ করাকে বলা হয় পোস্ট প্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট। তৃতীয় পদ্ধতিটি হল রানডাম ব্লাড সুগার টেস্ট। এই পদ্ধতিতে রক্ত পরীক্ষা করার জন্য বিশেষ কোনও সময়ে রক্ত নেওয়া হয়না। যে কোন সময় রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রোগী খাবার খেয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য নেয়া হয়না।রক্ত-শর্করা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়ার জন্য এই টেস্ট করা হয়।

পরীক্ষার ফলাফল এবং নর্মাল লেভেল Test results and normal levels

ফাস্টিং ব্লাড সুগার Fasting blood sugar

এক্ষেত্রে নর্মাল লেভেল হল, 50 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার থেকে 110 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার। কিন্তু ফাস্টিং ব্লাড সুগারের মাত্রা যদি 130 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটারের বেশি হয়, তবেই আমরা ডাক্তারের পরামর্শ নেব।

পি পি ব্লাড সুগার PP blood sugar

এক্ষেত্রে নর্মাল লেভেল হল 50 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটার থেকে 130 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার। এক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা 140 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটারের বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

রানডাম ব্লাড সুগার Random blood sugar

এক্ষেত্রে নর্মাল লেভেল হল 50 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটার থেকে 130 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটার। এক্ষেত্রেও ব্লাড সুগারের মাত্রা 140 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটারের বেশি হলে, তবেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

নর্মাল লেভেল নির্ভর করবে রোগীর খাদ্যাভ্যাস, রোগীর শারীরিক অবস্থা এবং রোগীর অন্ত্রের মধ্যে অর্থাৎ পৌষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে কোনরকম অস্ত্রোপচার হয়েছে কিনা সেই সকল বিষয়ের উপর। এছাড়া দেখতে হবে বংশের মধ্যে কি ধরনের ব্লাড সুগার লেভেলের প্রবণতা আছে। রক্তের শর্করার পরিমাণ আরও অনেক বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। রক্তের শর্করা কম বা বেশি হওয়া নির্ভর করে, বিশেষ করে সেই মুহূর্তে রোগী কোন রোগে ভুগছেন কিনা তার উপরে। মহিলাদের ক্ষেত্রে রোগী গর্ভবতী কিনা অর্থাৎ প্রেগনেন্সি আছে কিনা, থাকলে কোন দশায় আছেন বা প্রেগনেন্সির কোন পর্যায়ে চলছে ইত্যাদিও বিচার করা প্রয়োজন। এছাড়া কোন হার্টের রোগ বা অন্য কোন রোগ আছে কিনা,কোন মেটাবলিক ডিজিজ অচ্ছে কিনা ইত্যাদিও ভাবনা চিন্তার মধ্যে রাখা উচিত। অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির কোন সমস্যা থাকলেও তার উপরে নরমাল লেভেল কম বেশি হতে পারে।

ল্যাবরেটরি অনুসারে এবং ল্যাবরেটরিতে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপরেও নরমাল লেখা নির্ভর করে। কেমিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্লাড সুগার টেস্ট করার চেয়ে, উৎসেচক ব্যবহার করে ব্লাড সুগার টেস্ট করা বেশি ভাল। ল্যাবরেটরি রিপোর্টে লেখা নরমাল লেভেল মেনে চলা সব থেকে ভাল।এছাড়া টেস্ট রিপোর্ট কখনই 100% নিখুঁত বলা যায় না। প্রায় 10 শতাংশ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া আছে হিউম্যানের অর্থাৎ মানুষের দ্বারা ল্যাবরেটরি টেস্টিং এর সময় করা ভুল। সব মিলে টেন পার্সেন্ট ভুল অবশ্যই মেনে চলা প্রয়োজন।

রোগীর শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার সাথে ল্যাবরেটরি রিপোর্ট দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ রোগীর সুগার হয়েছে কি হয়নি ডায়াবেটিস হয়েছে কি হয়নি সেটা সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় শুধুমাত্র ল্যাবরেটরি রিপোর্ট দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ হবেনা।

আরও কি কি টেস্ট করা প্রয়োজন? What other tests need to be done?

ব্লাড সুগার সম্পর্কে ধারণা পেতে আরও কিছু আধুনিক টেস্ট করার প্রয়োজন হতে পারে তার মধ্যে একটি হল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট, সংক্ষেপে কি বলা হয় GTT, এই পরীক্ষার সাহায্যে ডায়াবেটিস সম্পর্কে বেশ খানিকটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু এই পরীক্ষাটি করার জন্য বেশ কয়েকবার রক্ত নিতে হয় বলে পরীক্ষাটি সামান্য কষ্টদায়ক বলা যেতে পারে।

সর্বাধুনিক যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সেটি হল হিমোগ্লোবিন এ এন সি টেস্ট। হিমোগ্লোবিন A 1C টেস্ট, অর্থাৎ গ্লাইকোসাইড হিমোগ্লোবিন টেস্ট, কোন রোগী কতদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছে এবং ডায়াবেটিস কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে সেটা জানতে, খুবই কার্যকরী। এখন ডায়াবেটিস কি অবস্থায় আছে এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগী ডায়াবেটিস কতটা সঠিক ভাবে কন্ট্রোল করছেন, সেটা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায় এই টেস্টের মাধ্যমে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, রোগী কি সঠিক ডায়েট কন্ট্রোল করছেন, নিয়ম মেনে চলছেন নাকি একেবারে নিয়ম মেনে চলছেন না, সুগার কন্ট্রোল নেই, ইত্যাদি সম্পর্কিত সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যেতে পারে এই হিমোগ্লোবিন A1 C টেস্টের মাধ্যমে।

আলোচনা শেষ করবো শেষ কয়েকটি কথা বলে। যদি আমাদের ডায়াবেটিস হয়ে গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আমাদের নিয়মিত রক্তের শর্করা অর্থাৎ ব্লাড সুগার টেস্ট করতে হবে। ফাস্টিং এবং পি পি সুগার টেস্ট করতে হবে এবং কিছু দিন অন্তর অন্তর অস্থায়ী হিমোগ্লোবিন A1 C টেস্ট করতে হবে। যেসকল ব্যক্তিদের এখনো ডায়াবেটিস হয়নি, ব্লাড সুগার স্বাভাবিক আছে, সেই সকল ব্যক্তিদের সঠিক জীবন যাপন করতে হবে জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে হবে এবং অবশ্যই বছরে একবার রক্তের শর্করা পরিমাপ করতে হবে অর্থাৎ ব্লাড সুগার টেস্ট করতে হবে।