ভিটামিন C এর অভাব দূর করবেন কিভাবে? How To Prevent Vitamin C Deficiency
ভিটামিন C আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। ভিটামিন C আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে আমাদের ত্বক, হাড়, দাঁত ইত্যাদির স্বাস্থ্য রক্ষা করতে দারুণ উপকারী। দেহে ভিটামিন C এর অভাব হলে বেশকিছু জটিল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে ভিটামিন C এর অভাব দূর করার উপায় নিয়ে। শেষ পর্যন্ত পড়লে সহজেই জানতে পারবেন, কোন কোন ফল ও সবজি খেলে দেহে ভিটামিন C এর অভাব দূর হবে। সবশেষে আলোচনা করা হয়েছে, রান্না করা খাবারের কেন ভিটামিন C কম পাওয়া যায় সেটা নিয়ে।
ভিটামিন C কি? What is Vitamin C?
প্রথমে জেনে নিই, ভিটামিন C আসলে কী? জলে দ্রবণীয় একপ্রকার ভিটামিন হল ভিটামিন C, যার রাসায়নিক নাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। এই ভিটামিন আমাদের দেহে তৈরি হয় না, তাই আমরা আমাদের খাদ্য থেকে ভিটামিন C গ্রহণ করি।
ভিটামিন C এর উপকারিতা: Benefits of Vitamin C:
ভিটামিন C এর উপকারিতা অনেক। আমাদের দেহের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে ভিটামিন C এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করে এই ভিটামিন। কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে ভিটামিন C, তাই ক্ষত সারিয়ে তুলতে, ত্বককে সুন্দর ও উজ্জ্বল রাখতে ভিটামিন C এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্ত্রে আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি করতে ভিটামিন C অবশ্য প্রয়োজনীয়। আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেহে হিমোগ্লোবিনের উৎপাদন বাড়ে ও রক্তাল্পতার ঝুঁকি কমে। এছাড়া ভিটামিন C হল একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরকে ফ্রি রেডিক্যাল এর হাত থেকে রক্ষা করে ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
ভিটামিন C-এর প্রাকৃতিক উৎস: Natural Sources of Vitamin C:
ভিটামিন C এর অভাব দূর করার জন্য ফল ও শাকসবজির দিকে নজর দিতে হবে। তাজা মরসুমী ফল ও শাকসবজি গ্রহণ করা বেশি ভালো। তবে কোল্ড স্টোরে রাখা শাকসবজি ও ফল থেকেও ভিটামিন C পাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন C এর সর্বোত্তম উৎস গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল।
লেবু জাতীয় ফল: Citrus Fruits:
লেবু জাতীয় ফল বিশেষ করে কমলালেবু, পাতি লেবু, মুসাম্বি ইত্যাদি ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C পাওয়া যায়। মাত্র একটি কমলা বা মুসাম্বি ভিটামিন C এর দৈনিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। লেবু জাতীয় ফল খুব সহজলভ্য ও প্রতিদিন খাওয়া যায়।
আমলকী: Amalaki:
আমলকী ভিটামিন C এর একটি চমৎকার উৎস। আমলকীর মধ্যে খুব বেশি পরিমাণ ভিটামিন C পাওয়া যায়। একটিমাত্র আমলকী আমাদের দেহের এক সপ্তাহের ভিটামিন C – র চাহিদা পূরণ করতে পারে। এছাড়া আমলকীর মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে আমলকী আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। কাঁচা আমলকী খেলে পর্যাপ্ত ভিটামিন C পাওয়া যাবে।
পেয়ারা: Guava:
পেয়ারার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C আছে। পেয়ারার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ভিটামিনের মাত্রা সামান্য কমবেশি হতে পারে। আমাদের ভিটামিন C – র দৈনিক চাহিদার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ ভিটামিন C থাকে পেয়ারাতে। খাদ্য তালিকায় অবশ্যই পেয়ারা যোগ করতে হবে। এটি খুব সহজলভ্য, তাই নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে।
পেঁপে: Papaya:
পেঁপে খুব পরিচিত একটি বেরি জাতীয় ফল। তাজা পাকা পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C থাকে। এক কাপ পেঁপে থেকে আমরা আমাদের দৈনিক ভিটামিন C এর চাহিদার প্রায় 90% পূরণ করতে পারি। এছাড়া পেঁপেতে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাইবার, ফলেট ও ভিটামিন A । পেঁপে সুস্বাদু, তাই তাজ পাকা পেঁপে গ্রহণ করা সবচেয়ে ভালো।
স্ট্রবেরি: Strawberries:
স্ট্রবেরি ভিটামিন C এর বেশ ভালো উৎস। এক কাপ স্ট্রবেরি আমাদের দৈনিক ভিটামিন C – র চাহিদা খুব সহজেই পূরণ করতে পারে। স্ট্রবেরির মধ্যে ভিটামিন C ছাড়াও ফাইবার, ফলেট, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইত্যাদি থাকার কারণে স্ট্রবেরি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। স্ট্রবেরি মূত্রনালির ইনফেকশন দূর করতেও যথেষ্ট উপকারী, তাই খাদ্য তালিকায় স্ট্রবেরি যোগ করা দরকার।
আম: Mango:
ফলের রাজা হল আম। আমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C, ভিটামিন A এবং ফাইবার থাকে। একারণে আম আমাদের দৃষ্টি শক্তি উন্নত করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও আমরা সার্বিকভাবে সুস্থ থাকি। আম সুস্বাদু হওয়ার কারণে আমরা সকলেই খুব পছন্দ করি। ভিটামিন C ও ভিটামিন A – এর অভাব মেটানোর বেশ ভালো উপায় হল আম উপভোগ করা।
আনারস: Pineapple:
আনারস ভিটামিন C ও ব্রোমলেন (Bromelain) সমৃদ্ধ, একারণে আনারস খেলে হজম ভালো হয় ও প্রদাহ কমে। এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল আনারস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার সাথে সাথে প্রোটিন হজম করতে সাহায্য করে। আনারস প্রাকৃতিক-ভাবে মিষ্টি ও সুস্বাদু, তাই খাদ্য তালিকায় আনারস যোগ করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
লঙ্কা: Green Chilies:
লঙ্কা ঝাল হতে পারে, কিন্তু লঙ্কাকে ভিটামিন C-এর ভাণ্ডার বলা যেতে পারে। লঙ্কার মধ্যে লেবু জাতীয় ফলের চেয়েও বেশি পরিমাণ ভিটামিন C থাকে। এছাড়া লঙ্কার মধ্যে থাকে ক্যাপসাইচিন (Capsaicin), যা ব্যথা উপশম করে ও বিপাক নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করতে লঙ্কার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই আমাদের দেশের বেশিরভাগ রান্নায় লঙ্কা ব্যবহার করা হয়।
টমেটো: Tomato:
টমেটো ভিটামিন C ও লাইকোপিনের একটি চমৎকার উৎস। ভিটামিন C ও লাইকোপিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়ার কারণে হার্টের স্বাস্থ্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন C এর অভাব পূরণ করতে টমেটো দারুণ ভূমিকা পালন করতে পারে। টমেটো বিভিন্নভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে স্যালাডে টমেটো খাওয়া সবচেয়ে ভালো।
সজিনা: Moringa:
সজিনা গাছের ফল ও পাতা আমরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকি। সজিনার মধ্যে থাকা ভিটামিন C ও অন্যান্য পুষ্টিগুণের কারণে সজিনাকে সুপার ফুড বলা হয়। ভিটামিন ছাড়াও সজিনার মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম। একারণে খাদ্য তালিকায় বিশেষ করে স্যালাডে, সজিনা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
সবুজ শাকসবজি: Cruciferous Vegetable:
আমরা সকলেই জানি যে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য সবুজ শাকসবজি বেশ ভালো। তবে এটা জেনে অবাক হতে হয় যে, সবুজ শাকসবজির মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন C থাকে। দেহে ভিটামিন C এর অভাব পূরণ করতে ব্রোকলি, পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি গ্রহণ করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। স্যালাডে এই ধরনের শাকসবজি যোগ করে খাওয়া যেতে পারে।
মিষ্টি আলু: Sweet Potatoes:
মিষ্টি আলু ভিটামিন C, ফাইবার ও বিটা ক্যারোটিনের দারুণ উৎস। এগুলি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মিষ্টি আলু প্রোটিন সমৃদ্ধ ও শিশুদের খাদ্য হিসেবে খুব জনপ্রিয়। মিষ্টি আলু সিদ্ধ করে বা পুড়িয়ে খাওয়া হয়, তবে কাঁচা খাওয়া সব থেকে ভালো।
ভিটামিন C এর দৈনিক চাহিদা: Daily Requirement of Vitamin C:
সাধারণত মহিলা ও পুরুষ উভয়ের জন্য দৈনিক 65 থেকে 90 মিলিগ্রাম ভিটামিন C গ্রহণ করা যথেষ্ট। তবে 2000 মিলিগ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়। ভিটামিন C জলে দ্রবীভূত ভিটামিন, তাই বেশি খেলেও তেমন কোনও সমস্যা হয় না। অতিরিক্ত ভিটামিন C মূত্রের মাধ্যমে শরীরের বাইরে বেরিয়ে যায়।
রান্না করা খাবারে ভিটামিন C:
রান্না করা খাবারে ভিটামিন C থাকে, তবে এটি জল-দ্রবণীয় ও তাপ-সংবেদী হওয়ার কারণে রান্নার সময় সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রায় দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করলে ভিটামিন C – এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য-ভাবে কমে যায়। রান্নার সময় ভিটামিন C-এর অপচয় রোধ করতে কম তাপমাত্রায় অল্প সময় ধরে রান্না করা উচিত। ভিটামিন C যুক্ত খাবার গুলি কাঁচা অবস্থায় খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ফল সরাসরি কাঁচা অবস্থায় খেতে হবে এবং স্যালাডে সবজি যোগ করা যেতে পারে। সবসময় মরসুমী স্থানীয় ফল খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। স্থানীয় মরসুমী ফলে পুষ্টিগুণ বেশি থাকে, সহজে হজম হয় এবং খরচও কম হয়।
