ম্যাগনেসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ: দেহে ম্যাগনেসিয়ামের অভাব আছে কিনা বুঝবেন কিভাবে? Worning Signs of Magnesium Deficiency.
ম্যাগনেশিয়াম হল একটি অতি-মাত্রিক খনিজ মৌল। ম্যাগনেশিয়াম আমাদের শরীরের কাজ স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা খাদ্যের মাধ্যমে এই খনিজটি গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু অনেক সময় বিভিন্ন কারণে আমাদের দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব ঘটতে পারে। দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। এই প্রতিবেদনে ম্যাগনেশিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করব।
দেহে ম্যাগনেসিয়ামের ভূমিকা: Role of Magnesium in the Body:
আমাদের শরীরের কাজ স্বাভাবিক রাখার জন্য ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যে সকল খনিজ মৌলগুলি আমাদের বৃদ্ধি ও পুষ্টির জন্য অধিক মাত্রায় প্রয়োজন হয় তাদের মেজর এলিমেন্ট বা অতি-মাত্রিক খনিজ মৌল বলা হয়। ম্যাগনেশিয়াম একটি অতি-মাত্রিক খনিজ মৌল। এটি 300টির বেশি জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার সাথে জড়িত। তাই হৃৎপিণ্ড, পেশী, স্নায়ু, হাড়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ, শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি কাজে ম্যাগনেশিয়ামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
রক্তে ম্যাগনেশিয়ামের অভাবকে হাইপোম্যাগনেশেমিয়া বলা হয়। রক্তরসে অর্থাৎ সিরামে ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ 1.8 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার অর্থাৎ 0.74 মিলি-মোল/লিটার-এর কম হলে, দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব আছে বলা হয়।
ম্যাগনেশিয়াম যুক্ত খাদ্য কম গ্রহণ করলে দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হতে পারে। এছাড়া যারা মদ্যপান করেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যারা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব দেখা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালের একটি গবেষণায় ম্যাগনেসিয়ামের গুরুত্ব সম্পর্কে আরও বেশ কিছু তথ্য জানা গিয়েছে।
ম্যাগনেশিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ: Symptoms of Magnesium Deficiency:
বদহজম: Indigestion:
হজম ভালো রাখতে ম্যাগনেসিয়াম এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ম্যাগনেশিয়াম অন্ত্রের চলন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ম্যাগনেশিয়াম পৌষ্টিকতন্ত্রের পেশীগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে, ফলে মল মসৃণভাবে চলাচল করে ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয়না। দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে পেট ব্যথা, পেট ফোলা, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরে বদ হজমের সমস্যা থাকলে জীবনযাত্রার মানের উপর প্রভাব পড়ে ও বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই দীর্ঘদিন ধরে হজমের সমস্যা হলে অবশ্যই রক্তে ম্যাগনেশিয়ামের মাত্রা পরীক্ষা করা দরকার। এছাড়া ম্যাগনেশিয়াম-যুক্ত খাদ্য ও সম্পূরক গ্রহণ করলে হজমের সমস্যা কমতে পারে।
পেশীতে টান এবং খিঁচুনি: Muscle Spasms and Cramps:
দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাবের কারণে পেশীতে টান ও খিঁচুনি হতে পারে। সাধারণত ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম বা পটাশিয়ামের অভাবে এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। ম্যাগনেশিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পায়ে খিঁচুনি। তবে ম্যাগনেসিয়ামের অভাব ছাড়া অন্যান্য বেশ কিছু স্নায়ু রোগে পেশীতে টান ধরতে পারে।
ক্লান্তি ও দুর্বলতা: Fatigue &Weakness:
ক্রমাগত ক্লান্ত বোধ করলে, দেহে শক্তির অভাব হলে, দুর্বল বোধ করলে সেটা ম্যাগনেশিয়ামের অভাবের কারণে হতে পারে। ক্লিনিক্যাল কিডনি জার্নাল-এর মতে দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তির অন্যতম কারণ হল ম্যাগনেসিয়ামের অভাব। কোষের শক্তি উৎপাদনের জন্য ম্যাগনেশিয়াম অপরিহার্য। পর্যাপ্ত ম্যাগনেসিয়াম ছাড়া শরীরের শক্তি উৎপাদন ব্যাহত হয়, ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতার অনুভূতি হয়। বিশ্রাম নিলেও এই ধরনের ক্লান্তি দূর হয় না। এর ফলে দৈনন্দিন কাজ কঠিন হয়ে পড়ে এবং সামগ্রিকভাবে সহনশীলতা হাস পায়।
উদ্বেগ ও বদমেজাজ: Anxiety and Mood Disorders:
শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানসিক সুস্থতার জন্য ম্যাগনেশিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং মেজাজ হাড়িয়ে ফেলার মত সমস্যা হতে পারে। ম্যাগনেশিয়াম মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরণকারী রাসায়নিকের কাজে সাহায্য করে। এছাড়া এটি ট্রেস হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে। দেখে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে এই সকল কাজ বাধা পায় ও মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ম্যাগনেশিয়াম সম্পূরক গ্রহণ করলে মেজাজ ভালো হয় ও বিষণ্ণতার লক্ষণগুলি হ্রাস পায়।
ঘুমের ব্যাঘাত: Sleep Disturbance:
ঘুমের ব্যাঘাত হলে দেহে ম্যাগনেশিয়ামের অভাব আছে কিনা দেখা দরকার। ম্যাগনেশিয়াম আমাদের ঘুমকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। ঘুমের চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে মেলাটোনিন নামক হরমোন। এই মেলাটোনিনের কাজ নিয়ন্ত্রণে ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। পর্যাপ্ত ম্যাগনেসিয়াম ছাড়া ঘুমিয়ে পড়তে অসুবিধা হতে পারে।, বারে বারে ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। ঘুমের সমস্যা হলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ক্ষতি হয় ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন: Irregular Heartbeat:
হৃৎপিণ্ডের কাজ স্বাভাবিক রাখার জন্য ম্যাগনেশিয়ামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ম্যাগনেসিয়াম ও এন্ডোথেলিয়াম ও রক্তনালী স্বাস্থ্য রক্ষা করে সামগ্রিকভাবে হৃৎপিণ্ডের উপকার করে। বুক ধড়ফড়, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি রোগ লক্ষণ দেখা গেলে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি আছে কিনা দেখা দরকার। পর্যাপ্ত ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করলে হার্টের রোগ প্রতিরোধ করা যায় ও হার্ট ভালো থাকে।
অস্টিওপোরোসিস: Osteoporosis:
হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে ক্যালসিয়ামের গুরুত্ব আমরা সকলেই জানি। কিন্তু হাড় শক্ত করতে ম্যাগনেসিয়ামও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়ামের শোষণে সাহায্য করে। এই ভিটামিন ডি কে সক্রিয় করতে ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজন। ম্যাগনেশিয়াম ছাড়া ক্যালসিয়াম সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় না, ফলে হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ম্যাগনেশিয়ামের অভাব হলেও অস্টিওপোরোসিস হতে পারে।
হাঁপানি: Asthma:
2019 সালের একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে ম্যাগনেশিয়াম দীর্ঘস্থায়ী হাঁপানির চিকিৎসায় বেশ কার্যকরী। ম্যাগনেসিয়াম শ্বাসনালী কে প্রসারিত হতে সাহায্য করে ও ম্যাগনেশিয়ামের প্রদাহ বিরোধী, তাই হাঁপানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাদ্যে ম্যাগনেসিয়াম থাকা দরকার। অনেক চিকিৎসক জরুরি অবস্থায় শিরায় ম্যাগনেশিয়াম ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেন, তবে এবিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
মন্তব্য: Remarks:
ম্যাগনেশিয়ামের অভাবজনিত কোন রোগ লক্ষণ দেখা গেলে অবশ্যই সাবধান হতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের ম্যাগনেশিয়াম টেস্ট করতে হবে। এছাড়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিদিন 300 থেকে 800 মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করা যেতে পারে। দেহে ম্যাগনেসিয়ামের অভাব থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও ম্যাগনেশিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
তথ্যসূত্র: Reference:
Healthline, Healthdirect, MedicalNewsToday, Clevelandclinic, e.t.c.