যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিস: কারণ, রোগ লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা। Tuberculosis: Cause, Symptoms, Diagnosis and Treatment.
যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিস হল একটি সংক্রামক রোগ যা সাধারণত ফুসফুসকে আক্রমণ করে। তবে চুল ও নখ ছাড়া শরীরের যে কোন অঙ্গে যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিসের সংক্রমণ হতে পারে। এই রোগ অনেক সময় মারাত্মক হয়ে ওঠে। আগে যক্ষ্মা বা টিবি ছিল বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে টিবি রোগের প্রকোপ অনেকটাই কমেছে।
এই প্রতিবেদনে যক্ষ্মা বা টিউবারকিউলোসিসের কারণ, রোগ লক্ষণ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হল।
যক্ষ্মা কী? What is tuberculosis?
মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে যক্ষ্মা বা টিবি রোগের সৃষ্টি হয়। প্রধানত ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটলেও মেরুদণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি ইত্যাদি সহ যেকোন অঙ্গে এই রোগের সংক্রমণ হতে পারে। টিবির জীবাণুর সংক্রমণ হলেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন এমন নয়; তবে অসুস্থ হয়ে পড়লে অবশ্যই চিকিৎসা করা প্রয়োজন। দেহে যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর সংক্রমণ হওয়া স্বত্বেও কোন রোগ লক্ষণ না থাকলে, যক্ষ্মা রোগ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে বা সুপ্ত অবস্থায় আছে বলা যেতে পারে। মনে হতে পারে যে রোগ সেরে গিয়েছে, কিন্তু এটি শরীরের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় আছে অর্থাৎ ঘুমাচ্ছে।
যক্ষ্মা বা টিবির সংক্রমণের তিনটি পর্যায়ে আছে; প্রাথমিক যক্ষ্মা সংক্রমণ, সুপ্ত যক্ষ্মা সংক্রমণ এবং সক্রিয় যক্ষ্মা সংক্রমণ। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির টিবি রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ডায়াবেটিস হলে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হলে, পুষ্টির অভাব হলে এবং তামাক ও অ্যালকোহল সেবন করলে টিবি রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
যক্ষ্মা কিভাবে ছড়ায়? How is tuberculosis spread?
সক্রিয় টিবি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, কথা বলা, গান গাওয়া, এমনকি হাসির মাধ্যমেও বাতাসে জীবাণু নির্গত হয়। বাতাসের মাধ্যমে এই জীবাণু সুস্থ ব্যক্তির দেহে সংক্রমণ ঘটায়। বেশিরভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে ও রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। আবার বেশ কিছু ব্যক্তির দেহে এই জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থেকে যেতে পারে এবং পরে সক্রিয় হতে পারে। এমনকি আজীবন সুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থেকে যেতে পারে এই জীবাণু।
টিবি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়লে। এক্ষেত্রে আমাদের শরীর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি বন্ধ করতে পারেনা, ফলে সক্রিয় টিবি রোগ দেখা দেয়। আবার অনেক সময় সুপ্ত টিবি সংক্রমণ থেকে সক্রিয় টিবি হতে পারে।
যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ: Symptoms of Tuberculosis:
আমাদের ইমিউন সিস্টেম অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাল থাকলে টিবি রোগের জীবাণুর সংক্রমণ হলেও তেমন কোনও সমস্যা হয় না। এক্ষেত্রে টিবির ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয় বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় চলে যায় ও কোন উপসর্গ সৃষ্টি করে না। জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থেকে গেলেও এটা তেমন কোন জটিলতা নয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
সক্রিয় সংক্রমণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু রোগ লক্ষণ দেখা যায়। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি, কফের মধ্যে রক্ত, বুকে ব্যথা, সন্ধ্যায় ঘুসঘুসে জ্বর ইত্যাদি রোগ লক্ষণ দেখা যায়। এছাড়া ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, ঠাণ্ডা লাগা ও রাত্রে ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
ফুসফুস ছাড়া দেহের অন্য কোন অঙ্গে টিবির সংক্রমণ হলে সেই অঙ্গ ফুলে যায় ও ব্যথা হয়। এছাড়া আগে উল্লেখ করা রোগ লক্ষণ গুলিও থাকতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে রোগ লক্ষণগুলি সামান্য ভিন্ন হতে পারে। তবে কিশোরদের রোগ লক্ষণগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের মতই হয়। 1 থেকে 12 বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ওজন কমে যাওয়া, জ্বর, কম চঞ্চলতা, কোন অঙ্গ ফুলে থাকা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়: Diagnosis of tuberculosis:
সাধারণত টিবি রোগ শনাক্ত করার জন্য ত্বকের মধ্যে মান্টু বা টিউবারকিউলিন টেস্ট করা হয়। এছাড়া ফুসফুসের যক্ষ্মা সনাক্ত করার জন্য এক্স রে বা সি টি স্ক্যান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এই পরীক্ষাগুলির সাহায্যে নিশ্চিতভাবে টিবি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। একারণে, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষা হল কফ পরীক্ষা “স্পুটাম ফর অ্যাসিড ফাস্ট ব্যাসিলাস”। এছাড়া IGRA অর্থাৎ ইন্টারফেরন-গামা-রিলিজ-অ্যাসে নামক রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, প্রাথমিক পর্যায়ে টিবি রোগ সনাক্ত করার জন্য রাপিড মলিকিউলার ডায়াগনস্টিক টেস্ট করার পরামর্শ দেয়। এই পরীক্ষাগুলি নিশ্চিতভাবে যক্ষ্মা রোগের সংক্রমণ সনাক্ত করতে পারে। দেহের অন্য কোন অঙ্গ যেমন লসিকা গ্রন্থিতে টিবি হলে FNAC নামক বিশেষ ধরনের বায়পসি করে রোগ সনাক্ত করা হয়।
যক্ষ্মার চিকিৎসা Tuberculosis treatment
টিবি রোগের চিকিৎসা রোগের তীব্রতার উপর নির্ভরশীল। যক্ষ্মার চিকিৎসা করার জন্য ইথামবুটল, আইসোনিয়াজিড, পাইরাজিনামাইড, রিফাম্পিন ইত্যাদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। কমপক্ষে 6 মাস থেকে 1 বছর টানা ওষুধ খেতে হয়। ড্রাগ রেজিসস্ট্যান্ট টিবি হলে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক 30 মাসের বেশি সময় ধরে খেতে হতে পারে।
সুপ্ত, সক্রিয় বা ড্রাগ রেজিসস্ট্যান্ট, যে ধরনের সংক্রমণই হোক না কেন, নিয়মিত টানা ওষুধ খাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোগ সেরে গিয়েছে ভেবে মাঝপথে ওষুধ ছেড়ে দিলে সমূহ বিপদ। চিকিৎসা নিয়ম মেনে শেষ না করলে ড্রাগ রেজিসস্ট্যান্ট টিবির সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
যক্ষ্মা প্রতিরোধ: Prevention of tuberculosis:
যক্ষ্মা সংক্রমণ এবং যক্ষ্মার বিস্তার প্রতিরোধ করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থাযুক্ত বাড়িতে বসবাস করা দরকার। স্যাঁতসেঁতে জানলা বিহীন ঘরে বসবাস করা চলবে না। যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সাথে এক ঘরে বসবাস না করাই ভাল।
টিবি রোগের কোন লক্ষণ দেখা গেলে যেমন দীর্ঘস্থায়ী কাশি, কফে রক্ত, জ্বর ইত্যাদি থাকলে অবশ্যই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। যক্ষ্মার সংক্রমণ হলে অবশ্যই নিয়ম মেনে টানা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হবে। ওষুধের কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে হবে। যদি আপনার টিবি রোগ হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে হাঁচি কাশির সময় মুখে রুমাল চাপা দিন বা মাস্ক ব্যবহার করুন। অন্য ব্যক্তির সাথে কথা বলার সময়ও মাস্ক পড়া দরকার। যেখানে সেখানে থুতু ফেলা একেবারেই নিষেধ। প্রতিদিন ঘরের মেঝে, বাথরুম ইত্যাদি ফিনাইল ব্যবহার করে পরিষ্কার করতে হবে। HIV আক্রান্ত ব্যক্তিদের আরও একটু বেশি সচেতন থাকা দরকার।