Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাখাদ্য ও পানীয় Food & Drinks

যে 10টি পরিবর্তন দেখলে বুঝবেন আপনি চিনি বেশি খান।  চিনি কেন সাদা বিষ? These 10 changes will tell you if you are eating too much sugar. Why is sugar a white poison?

আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বাস করি যেখানে চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় খুব সহজেই পাওয়া যায়। আর একারণে চিনি যে আমাদের ক্ষতি করে সেটা মাথায় থাকে না। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ক্ষতিকর। সমস্যা হল আমরা অনেকে বুঝতেই পারি না যে আমরা অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করছি।

শরীরে যে 10টি পরিবর্তন দেখলে বুঝবেন আপনি চিনি বেশি খান, সেই পরিবর্তনগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

প্রায় 2500 বছর ধরে আমরা চিনি ব্যবহার করে আসছি। এই সময়ের আগে মধু এবং ফলই ছিল একমাত্র মিষ্টি পদার্থ। দিনকে দিন আমাদের জীবনে চিনির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ পুষ্টি হিসাবে চিনির তেমন কোন ভূমিকা নেই। এটি কেবল স্বাদ উপভোগ করার জন্য এবং প্রিয়জনদের স্বাগত জানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।

ইংল্যান্ডের অধ্যাপক জন ইউডকিন (John Yudkin) চিনির বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন। তিনি চিনিকে সাদা বিষ বলে উল্লেখ করেছেন। চিনির কোন শারীরবৃত্তিয় প্রয়োজন নেই। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি ও পুষ্টি আমরা শাকসবজি, শস্য ও ফল থেকে পেতে পারি।

চিনি থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করলে শরীরে উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। এর ফলে ওজন বেড়ে যায় ও বিভিন্ন রোগব্যাধির হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। অতএব সাদা চিনি থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত ক্যালরি সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। চিনিতে কোন ভিটামিন, খনিজ উপাদান বা পুষ্টি উপাদান থাকে না।

অনেকেই মনে করে যে চিনি তাৎক্ষণিক শক্তির উৎস; কিন্তু চিনি ও মিষ্টির মধ্যে পার্থক্য আছে। ফলের মিষ্টি স্বাদের কারণ হল ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ; কিন্তু চিনির মিষ্টির স্বাদের কারণ সুক্রোজ। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে দেহে রোগ ব্যধি বাড়ে। চিনি রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায় ও রক্তনালী স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস করে।

অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে একটানা ক্লান্তি ও অবসাদের অনুভূতি হতে পারে। উচ্চ চিনেযুক্ত খাবার থেকে প্রচুর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায় ও সাময়িক শক্তি বৃদ্ধি পায়, তবে পরবর্তী সময় এটা বিপদে ফেলতে পারে। ক্লান্ত বোধ করার অনেক কারণ থাকতে পারে; তবে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। তাই ক্লান্তি ও অবসাদ দেখা গেলে খাদ্য তালিকার দিকে নজর দিতে হবে।

চিনি খেলে আমাদের ভালো লাগে, কারণ চিনি আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক নিউরোহরমোেনের উৎপাদন বাড়ায়। এই ডোপামিন আমাদের আনন্দের অনুভূতি দেয়; আর একারনে আমরা চিনির প্রতি আকৃষ্ট হই।

চিনির প্রতি আকর্ষণ কমানো বেশ কঠিন। তবে ধীরে ধীরে চিনি গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে ফল ও বাদাম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়।

যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে আপনার মুখমণ্ডল ফোলা দেখাচ্ছে, তাহলে সেটা অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের লক্ষণ হতে পারে। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে দেহে জলের পরিমাণ বাড়ে ও মুখ ফোলা দেখায়। চিনি গ্রহণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখলে এবং পরিমিত পরিমাণ জল পান করলে ফোলা ভাব কমে। জল ধরে রাখার পরিমান কমাতে শসা এবং শাকসবজি জাতীয় মূত্রবর্ধক খাবার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করলে খিদে বেড়ে যেতে পারে। চিনি মনকে সন্তুষ্ট করে কিন্তু পেট ভরার অনুভূতি দেয় না; অর্থাৎ পেটকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা। চিনিতে ফাইবার, প্রোটিন বা স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকে না, ফলে চিনি দ্রুত হজম হয়ে যায় ও খিদে বেড়ে যায়। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, চিনিযুক্ত মিষ্টি পানীয় গ্রহণ করার ফলে শিশুদের ওজন উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়।

আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রে উপস্থিত উপকারী অনুজীবগুলি আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুস্থ অন্ত্র আমাদের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে ও দেহে রক্তশর্কারার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অতিরিক্ত চিনি খেলে অন্ত্রের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়, ভালো ব্যাকটেরিয়া কমে যায় ও খারাপ ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পায়। এর ফলে অন্ত্রের কাজ ব্যাহত হয় ও বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়।

চিনি আমাদের ফ্যাট হরমোনগুলির ক্ষতি করে। ক্ষুধা নিবারণকারী হরমোন লেপটিনের ক্ষতি করে চিনি; ফলে বারে বারে খিদে পায়।

যদি আপনার মেজাজ খারাপ থাকে, সব সময় খিটখিট করেন বা অস্থির বোধ করেন, তাহলে এর কারণ শুধুমাত্র মানসিক নাও হতে পারে। অতিরিক্ত চিনি খেলেও এমন হতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অতিরিক্ত চিনি খেলে প্রদাহ বাড়তে পারে, মেজাজ খারাপ হতে পারে ও বিষণ্ণতা দেখা যেতে পারে। চিনিযুক্ত খাবার খেলে রক্তে দ্রুত শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, আর শরীর খুব তাড়াতাড়ি সেই শর্করাকে সঞ্চয় করে ফেলে; ফলে দেহে শক্তির অভাব হয়।

রক্তে যখন গ্লুকোজের মাত্রা কম থাকে তখন প্রচুর পরিমাণ চিনি খেলে ইনসুলিনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই অতিরিক্ত ইনসুলিন হঠাৎ করে মস্তিষ্কের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়।

পেট ব্যথা, বদহজম, ডায়রিয়া ইত্যাদির বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে অতিরিক্ত চিনি খেলেও এমন সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে ইরিট্যাবল বাউল সিনড্রোম, ক্রোনস ডিজিজ, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি রোগের জটিলতা বৃদ্ধি পায়।

উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে উচ্চমাত্রায় চিনি গ্রহণ। চিনিযুক্ত মিষ্টি পানীয় গ্রহণের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক আছে, এটা গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত। উচ্চমাত্রায় গ্লুকোজ আমাদের রক্তনালীর ক্ষতিসাধন করে রক্তনালীগুলিকে শক্ত করে তোলে। রক্তনালীতে কোলেস্টেরল জমে রক্তনালীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হলে, রক্তচাপ বেড়ে যায়। চিনির ভূমিকা এক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষতিকর।

ব্রণ বা অ্যাকনের সমস্যা বাড়তে থাকলে সেটা চিনি বেশি খাওয়ার কারণে হতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের সমস্যা থাকলে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল এমন একটি অবস্থা যেখানে  ইনসুলিন সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনা। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার খেলে এই সমস্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।

ত্বকের বলিরেখা বাড়াতে পারে অতিরিক্ত চিনি। চিনি বেশি খেলে এমন কিছু পদার্থ তৈরি হয় যা ত্বকের বার্ধক্যকে এগিয়ে নিয়ে আসে ও বলিরেখা বৃদ্ধি পায়।

প্রচুর পরিমাণ চিনি খেলে যেমন শরীর ভেঙে পড়ে, তেমনিই মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হতে পারে। চিনির শক্তিবৃদ্ধিকারী প্রভাব কেটে গেলে শারীরিক ক্লান্তির সাথে মানসিক ক্লান্তি, অলসতা, বিষন্নতা ইত্যাদি অনুভব করা যেতে পারে। উদ্বেগের অনুভূতি, হতাশা, হঠাৎ ভেঙে পড়া ইত্যাদি সমস্যার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ।

আমরা সকলেই জানি যে চিনি দাঁতের জন্য ভালো নয় এবং এটা সত্য। দাঁতের মধ্যে গর্ত সৃষ্টি হলে, দাঁতের শিকড়ের ক্ষতি হলে অবশ্যই ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিন। এই সমস্যার অন্যতম কারণ হতে পারে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ। চিনি দাঁতের ফাঁকে জমে থাকে ও দাঁতের এনামেলের ক্ষতি করে। এনামেলের ক্ষতি হলে দাঁতের মধ্যে সাদা দাগ দেখা যায়।

অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে সময়ের সাথে সাথে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ওজন বেড়ে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা, বদহজম, চিন্তাভাবনায় সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। একারণে খাদ্য তালিকায় চিনি যত কম রাখা যায় ততই ভালো। তবে অল্প কিছু পরিমাণ চিনিযুক্ত মিষ্টি খাবার অবশ্যই খাওয়া যেতে পারে।

healthline.com, Everyday Health, WebMD, Medical News Today e.t.c.