লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা কি? কোন রোগের জন্য কিভাবে লবঙ্গ ব্যবহার করবেন? Health benefits of eating cloves. What is the best way to consume cloves?
লবঙ্গ একটি ছোট্ট কিন্তু শক্তিশালী মসলা। খাদ্যে স্বাদ বৃদ্ধি করার সাথে সাথে আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে লবঙ্গ। এই সুগন্ধযুক্ত লবঙ্গ পুষ্টি উপাদান, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ঔষধিগুণে পরিপূর্ণ। প্রাচীনকাল থেকেই হজমে সহায়তা করার জন্য এবং রোগ প্রতিরোধ করার জন্য লবঙ্গের ব্যবহার হয়ে আসছে। লবঙ্গ খাওয়ার উপকারিতা কী, কোন রোগের জন্য কিভাবে লবঙ্গ ব্যবহার করবেন, এগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
লবঙ্গ কী? What are Clove Buds?
লবঙ্গ হল সিজিজিয়াম অ্যারোমাটিকাম (Syzygium aromaticum) নামক বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের ফুলের কুঁড়ি। সাধারণত গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলে এই গাছগুলি জন্মায়। লবঙ্গ গাছ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। এদের বাকল মসৃণ, পাতা সুগন্ধযুক্ত এবং গোলাপি সাদা রংয়ের ফুল ধরে। এই ফুলগুলিকে অপরিণত অবস্থায় অর্থাৎ কুঁড়ি অবস্থায় সংগ্রহ করে শুকিয়ে নিলে তাকে লবঙ্গ বলা হয়।
শুকিয়ে গেলে লবঙ্গ গুলিকে সম্পূর্ণ গোটা মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয় অথবা গুঁড়ো করেও ব্যবহার করা যেতে পারে। লবঙ্গ গাছের শুকনো কাণ্ড ও পাতা থেকে সুগন্ধি তেল পাওয়া যায়। এই তেলও বেশ উপকারী। ইংরেজিতে লবঙ্গকে ক্লোভ(Clove) বলা হয়। ক্লোভ কথাটি ল্যাটিন ভাষা ক্ল্যাভাস(Clavus) থেকে এসেছে। ক্ল্যাভাস মানে হল নখ। লবঙ্গ দেখতে অনেকটা নখের মত হওয়ার কারণে লবঙ্গকে ল্যাটিন ভাষায় ক্ল্যাভাস বলা হয়।
লবঙ্গের উপকারিতা: Health Benefits of Cloves:
দাঁতের ব্যথা উপশম করে: Soothes Toothaches:
লবঙ্গের ব্যথা নাশক বৈশিষ্ট্য দাঁতের ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। দাঁতের ব্যথা কমানোর প্রাকৃতিক কার্যকরী উপায় হল লবঙ্গ বা লবঙ্গ তেল ব্যবহার করা। লবঙ্গের প্রদাহ বিরোধী উপাদান দাঁতের প্রদাহ কমায়, ফোলা ও ব্যথা কমায়। এছাড়া লবঙ্গ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
এক টুকরো তুলোর মধ্যে সামান্য লবঙ্গ তেল নিয়ে ব্যথাযুক্ত দাঁত ও মাড়ির আশেপাশে ঘষতে হবে। এছাড়া লবঙ্গ গুঁড়ো করে সামান্য জলপাই তেল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগানো যেতে পারে। ব্যথাযুক্ত দাঁতের উপর লবঙ্গ পাতা কয়েক মিনিট রেখে দিলেও উপকার পাওয়া যায়।
মুখের দুর্গন্ধ দূর করে: Stops Bad Breath:
মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে লবঙ্গ বেশ ভালো কাজ করে। একারণে টুথপেস্ট ও মাউথওয়াসে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। লবঙ্গ মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সাহায্য করে। এছাড়া জিভ, তালু ও গলার উপরের অংশে প্লাক জমা হতে বাধা দেয়। লবঙ্গের তীব্র সুগন্ধ আমাদের নিঃশ্বাসকে সতেজ করতে সাহায্য করে।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
কয়েকটি লবঙ্গ চিবিয়ে খেলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যাবে। এছাড়া দিনে দুই থেকে তিনবার ঠাণ্ডা লবঙ্গ চা দিয়ে গার্গাল করা যেতে পারে।
হজম শক্তি বাড়ায়: Improves Digestion:
লবঙ্গ পেটের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পেটের মধ্যে গ্যাস উৎপাদনে বাধা দেয় ও পেট ফাঁপা রোধ করে। পাকস্থলীতে হজমে সাহায্যকারী উৎসেচকের উৎপাদন বাড়ায় ও হজমে সাহায্য করে। লবঙ্গ অন্ত্রের চলন স্বাভাবিক রাখে ফলে বমি, ডায়রিয়া, গ্যাস অম্বলের সমস্যা, পেট ব্যথা ইত্যাদি কমে। পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়, কারণ লবঙ্গ অন্ত্রের মিউকাস অর্থাৎ শ্লেষ্মা উৎপাদনে সাহায্য করে।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
হজমের উন্নতি করার জন্য খাদ্যে মশলা হিসাবে লবঙ্গ সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া মাউথ ফ্রেশনার হিসাবে লবঙ্গ চিবানো যেতে পারে।
বমি বমি ভাব দূর করে: Treats Nausea and Vomiting:
লবঙ্গ বমি ও বমি বমি ভাব দূর করতে সাহায্য করে। লবঙ্গের তীব্র সুগন্ধ মনকে প্রশান্তি দেয়। গর্ভাবস্থায় বমি বমি ভাব হলেও লবঙ্গ ব্যবহার করা যায়, এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি উপায়। তবে এবিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ব্যবহার পদ্ধতি: How to Use:
বমি বমি ভাব দূর করতে মুখের মধ্যে একটি লবঙ্গ রাখতে হবে। রুমালে কয়েক ফোঁটা লবঙ্গ তেল দিয়ে শ্বাস নিলেও বমি বমি ভাব কমে। বমি বন্ধ করতে অল্প একটু লবঙ্গের গুড়োর সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া এক গ্লাস হালকা গরম জলে কয়েক ফোঁটা লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ধীরে ধীরে পান করলে উপকার পাওয়া যায়।
জয়েন্টের ব্যথা উপশম করে: Relieves Joint Pain:
জয়েন্টের ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে লবঙ্গ তেল। লবঙ্গ তেল প্রদাহ কমায়, পেশির ব্যথা, বাতের ব্যথা ইত্যাদিও উপশম করতে পারে। লবঙ্গের মধ্যে ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, ওমেগা-3-ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি থাকার কারণে হাড়ের ঘনত্ব বাড়ে ও হাড় শক্ত হয়। হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে লবঙ্গের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
অলিভ অয়েলের মত উদ্ভিজ্জ তেলের সাথে লবঙ্গ তেল মিশিয়ে জয়েন্ট ও পেশিতে মালিশ করতে হবে। যেখানে ব্যথা ও ফোলা আছে সেখানে দিনে কয়েকবার মালিশ করতে হবে। এছাড়া একটি কাপড়ে কয়েকটি লবঙ্গ নিয়ে গরম করে আক্রান্ত স্থানের উপর গরম সেক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
মাথা ব্যথা কমায়: Treats Headaches:
মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে লবঙ্গ। লবঙ্গ তেল ব্যবহার করলে মাইগ্রেন, টেনশন, ঠাণ্ডা লাগা ইত্যাদির কারণে হওয়া মাথাব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। লবঙ্গ তেলের প্রদাহ বিরোধী ও ব্যথা উপশমকারী বৈশিষ্ট্যের কারণে মাথাব্যথা কমে।
ব্যবহার পদ্ধতি: How to Use:
একটি কাপড় বা টিস্যু পেপারে কয়েক ফোঁটা লবঙ্গ তেল লাগিয়ে কপালে 15 মিনিট রাখতে হবে। এর ফলে রক্তনালীগুলি শিথিল হবে ও মাথা ব্যথা কমবে। এছাড়া দুই চা চামচ পরিমাণ বাদাম তেল বা নারকেল তেলের মধ্যে দু-ফোঁটা লবঙ্গ তেল ও এক চা চামচ পরিমাণ সামুদ্রিক লবণ মিশিয়ে কপালে ম্যাসেজ করলে মাথা ব্যথা কমে।
ফুসফুসের উন্নতি ঘটায়: Improves Respiratory Health:
লবঙ্গ ও লবঙ্গ তেল উভয়ই ফুসফুসের জন্য খুব উপকারী, কারণ লবঙ্গের মধ্যে কফ নাশক ও জীবাণু নাশক বৈশিষ্ট্য আছে। সাধারণ সর্দি কাশি, নাক বন্ধ হওয়া, গলা ব্যথা, ভাইরাসের সংক্রমণ, হাঁপানি, যক্ষ্মা, ব্রংকাইটিস ইত্যাদির চিকিৎসায় লবঙ্গ ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ফুসফুসের ক্যান্সার বিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে লবঙ্গ।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
শ্বাসকষ্ট-জনিত সমস্যায় ভুগলে প্রতিদিন দুই থেকে তিন কাপ লবঙ্গ চা পান করতে হবে। গরম জলে লবঙ্গ যোগ করে তার সুগন্ধযুক্ত বাষ্প নিলেও উপকার পাওয়া যায়। শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধ করতে নিয়মিত একটি বা দুটি লবঙ্গ চিবিয়ে খান, উপকার পাবেন।
কানের ব্যথা কমায়: Eases Earaches:
লবঙ্গের মধ্যে হালকা চেতনা নাশক এবং জীবাণু নাশক উপাদান থাকে। একারণে লবঙ্গ কানের সংক্রমণ নিরাময় সাহায্য করতে পারে।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
সমান পরিমাণ লবঙ্গ তেল ও তিলের তেল একসাথে মিশিয়ে হালকা গরম করতে হবে। মিশ্রিত তেল অল্প একটু তুলোর মধ্যে নিয়ে কানের খাঁজের ভিতর রাখলে ব্যথা দ্রুত কমে যাবে। এটি সংক্রমণ দূর করতেও সাহায্য করবে। এছাড়া আরও একটি পদ্ধতি হল, এক টেবিল চামচ পরিমাণ লবঙ্গ চূর্ণ 50 মিলিলিটার পরিমাণ জলপাই তেলে মেশাতে হবে। এবার 30 মিনিট রেখে ছেকে নিন। আক্রান্ত কানে দু ফোটা এই তেল দিয়ে দশ মিনিট রাখার পর বের করে দিন; কানের ব্যথা কমে যাবে।
ব্রণ দূর করে: Cures Acne:
ব্রণ ও ত্বক সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যা যেমন ব্ল্যাকহেডস, হোয়াইট হেডস, ফুসকুড়ি, খসখসে ত্বক ইত্যাদির চিকিৎসায় লবঙ্গ বেশ কার্যকরী বলে প্রমাণিত। ব্রণ সেরে যাওয়ার পর যে দাগ দেখা যায়, সেটা দূর করতেও লবঙ্গ কার্যকরী হতে পারে। লবঙ্গের জীবাণু বিরোধী বৈশিষ্ট্য, ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে ও মুখের অন্যান্য অংশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করে। এছাড়া ব্রণ-র ব্যথা, জ্বালা ও লাল-ভাব কমায়।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
ব্রণ-র চিকিৎসার জন্য নারকেল তেলের সাথে লবঙ্গ তেল এক অনুপাত 10 হিসাবে মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
মানসিক চাপ কমায়: Fight Stress:
লবঙ্গের তীব্র সুগন্ধের কারণে এটি আমাদের মনকে প্রশান্ত করে এবং মানসিক চাপ কমে। মানসিক উত্তেজনা থাকলে আমাদের পেশীগুলি উত্তেজিত থাকে ও টানটান থাকে। লবঙ্গে উপস্থিত ইউজেনল (Eugenol) মানসিক চাপ কমায় ও পেশী শিথিল করে।
ব্যবহারের পদ্ধতি: How to Use:
স্নান করার সময় স্নানের জলে কয়েক ফোটা লবঙ্গ তেল যোগ করলে স্নানের অনুভূতি আরামদায়ক হয়। এটি আমাদের স্নায়ুকে শান্ত করে ও মানসিক চাপ দূর হয়। এছাড়া এক কাপ লবঙ্গ চা পান করলেও মানসিক চাপ কমে।
তথ্যসূত্র:
WebMD, Clevelend Clinic, MedicalNewsToday, Verywell Health e.t.c.