সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট: Serum Calcium Test:
রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বা বেশি হলে আমাদের হার্ট, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করা হয়। দেহে ক্যালসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিক আছে কিনা জানতে সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা হয়। সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করার আগে কী কী নিয়ম মেনে চলবেন সেটা জানতে সঙ্গে থাকুন।
কেন সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা প্রয়োজন? Why do I need a Serum Calcium Test?
দেহে উপস্থিত খনিজ উপাদান গুলির মধ্যে ক্যালসিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত রুটিন হেলথ চেকআপ করার সময় এই টেস্ট করা হয়। আমাদের দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সিরাম ক্যালসিয়ামের মাত্রার পরিবর্তন ঘটে। একারণে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করতে সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা হয়।
আমাদের দেহে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে। ক্যালসিয়াম আমাদের হাড় ও দাঁতের প্রধান উপাদান। ক্যালসিয়াম পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তনালীর গহবরকে প্রয়োজনমতো ছোট বা বড় করে। এছাড়া ক্যালসিয়াম স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সংবাদ আদান-প্রদানে ভূমিকা নেয়, হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। কোন স্থান কেটে গেলে, রক্তপাত হলে, রক্ত জমাট বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ক্যালসিয়াম।
আমাদের দেহে উপস্থিত মোট ক্যালসিয়ামের সবটাই প্রায় হাড়ের মধ্যে জমা থাকে। কেবলমাত্র 1% ক্যালসিয়াম রক্তে উপস্থিত থাকে।
বিভিন্ন কারণে সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা প্রয়োজন। আমাদের অস্থি, হার্ট, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি ইত্যাদি কেমন আছে, সেটা জানার জন্য সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা হয়। কোন ব্যক্তির প্যারাথাইরয়েড ও থাইরয়েড গ্রন্থি কেমন আছে সেটা জানার জন্য সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা হয়। কিডনিতে পাথর হয়েছে কিনা জানতে, এই টেস্ট করা প্রয়োজন।
কখন সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করতে দেয়া হয়? When is a Serum Calcium Test ordered?
সাধারণত জেনারেল হেলথ চেকআপ করার সময় সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করতে দেয়া হয়। ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ দেখা গেলে এই টেস্ট করতে দেয়া হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ মাত্রা অতিরিক্ত, বেশি বা কম না হওয়া পর্যন্ত তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায় না। একারণে দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি বা কম হলে যে লক্ষণ গুলি দেখা যায়, সেগুলি গুরুত্ব সহকারে বিচার করা প্রয়োজন।
কিডনি রোগগ্রস্ত হলে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে। কিডনি অসুস্থ হলে সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করতে দেওয়া হয়।
দেহে ক্যালসিয়াম বেশি হওয়ার লক্ষণ যেমন ক্লান্তি, দুর্বলতা, হজমে সমস্যা, ঝিমঝিম ভাব, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটে ব্যথা, তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলে অবশ্যই সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা প্রয়োজন।
দেহে ক্যালসিয়াম খুব কমে গেলে মাংসপেশীতে টানের সৃষ্টি হয়, পেটের পেশিতে টান ধরে এবং আঙুল ঝিনঝিন করতে পারে। এই সকল লক্ষণ দেখা গেলে অবশ্যই সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করতে বলা হয়।
কিছু রোগ যেমন থাইরয়েডের সমস্যা, প্যারা থাইরয়ডের সমস্যা, অপুষ্টি, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগে ক্যালসিয়ামের মাত্রার পরিবর্তন ঘটে, তাই এই সকল রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে মাঝে সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা প্রয়োজন।
ক্যান্সারের চিকিৎসা করার সময় সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করে দেহে সিরাম ক্যালসিয়ামের মাত্রা দেখে নেওয়া হয়।
যে সকল ব্যক্তি শরীরে ক্যালসিয়ামের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসার অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করা হয়।
কিডনিতে স্টোন হয়েছে কিনা জানার জন্য সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করার সাথে সাথে মুত্রে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ টেস্ট করা হয়।
সিরাম ক্যালসিয়াম পরীক্ষার প্রস্তুতি: Preparation of Serum Calcium Test:
সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্ট করার আগে অনাহারে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। কিছু ওষুধ যেমন লিথিয়াম জাতীয় ওষুধ, অ্যান্টাসিড, ভিটামিন D সাপ্লিমেন্ট, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি গ্রহণ করা নিষেধ।
কী কী ওষুধ সেবন করছেন সেটা ডাক্তারবাবু এবং ল্যাবরেটরীতে জানান। পরীক্ষার আগে খাদ্য তালিকায় বিশেষ কোনো পরিবর্তন করবেন না, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাদ্য অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ করা নিষেধ।
সিরাম ক্যালসিয়াম টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ: Sample collection for Serum Calcium Test:
হাতের শিরা থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। খুব অল্প পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন হয়। আঙুলে সূচ-বিদ্ধ করে রক্ত সংগ্রহ করা যেতে পারে, তবে হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা বেশি ভালো।
সিরাম ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা: Normal Range of Serum Calcium:
সিরাম ক্যালসিয়ামের নরমাল লেভেল হল:-
8.6 থেকে10.2 মিলিগ্রাম / ডেসিলিটার।
পরীক্ষা পদ্ধতি ও ল্যাবরেটরি অনুসারে নরমাল লেভেল সামান্য পরিবর্তনশীল। রিপোর্টে লেখা নরমাল লেভেল মেনে চলা সবথেকে ভালো।
সিরাম ক্যালসিয়াম পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা: What does the Serum Calcium Test Result mean?
রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি হতে পারে বেশ কিছু রোগে। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির অতি সক্রিয়তায় ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে কী কারণে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি অতি সক্রিয়, সেটা জানা প্রয়োজন। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থিতে টিউমার হলে এরকম হতে পারে।
থাইরয়েড গ্রন্থি বেশি কাজ করলেও সিরাম ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কিডনি, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি রোগগ্রস্ত হলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সারকয়ডোসিস নামক রোগে ক্যালসিয়াম এর মাত্রা বৃদ্ধি পায় বৃদ্ধি পায়।
বেশ কিছু ওষুধ যেমন লিথিয়াম, থায়াজাইড ডায়ইউরেটিকস সেবন করলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে বা ভিটামিন D সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম হতে পারে, যদি মূত্রের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম শরীরের বাইরে নির্গত হয়। প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি কম সক্রিয় হলে, কিডনি ফেলিওর হলে, প্যানক্রিয়েটাইটিস হলে অর্থাৎ প্যাংক্রিয়াস রোগাক্রান্ত হলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম হয়।
পৌষ্টিকতন্ত্রের ক্যালসিয়ামের শোষণ কম হলে বা বাধা প্রাপ্ত হলে, খাদ্যে ভিটামিন D-এর অভাব ঘটলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম হয়। ভিটামিন D পৌষ্টিকতন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণের সাহায্য করে।
কর্টিকোস্টেরয়েড, রিফ্যামপিন ইত্যাদি ওষুধ সেবন করলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমে। ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য কম গ্রহণ করলে বা অপুষ্টিতে ভুগলে রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম হয়।
দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম বা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসা করা প্রয়োজন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব সহজেই সমস্যার সমাধান ঘটে। অল্প কিছু সময় পরিকল্পনা মাফিক দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। সুতরাং রক্তের ক্যালসিয়াম টেস্ট করুন এবং সুস্থ থাকুন।