মলের রুটিন টেস্ট মল পরীক্ষা। Stool Analysis | Stool Examination.
মলের রুটিন টেস্ট মল পরীক্ষা। Stool Examination | Stool Analysis
পৌষ্টিকতন্ত্রের (Digestive System) মধ্যেকার অবস্থা বা স্বাস্থ্য কেমন আছে সেটা জানার জন্য মল পরীক্ষা Stool Test করা হয়। মলের নমুনা সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি টেস্ট করা হয়। পোষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে পরজীবী Parasite অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের কৃমি আক্রমণ করেছে কিনা, কোন ভাইরাস ঘটিত বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ইনফেকশন হয়েছে কিনা অথবা কোন প্রোটোজোয়া Protozoa বাসা বেধেছে কিনা, সেটা জানার সহজ উপায় হল মলের রুটিন টেস্ট অর্থাৎ মলের পরীক্ষা করা।
মল পরীক্ষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা। Basic understanding of stool tests
মল পরীক্ষা করার জন্য একটি পরিষ্কার পাত্রে মলের নমুনা Stool Sample সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা মলের নমুনা নিয়ে, তার রং, ঘনত্ব, পরিমাণ, গন্ধ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়। মিউকাস বা শ্লেষ্মার পরিমাণ কতটা আছে, সেটাও দেখা হয়। এছাড়া মলের মধ্যে রক্ত আছে কিনা, সেটা দৃশ্যমান বা গুপ্ত রক্তপাত যায়ই হোক, সেটা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া দেখা হয় চর্বি, মাংসের ফাইবার, পিত্ত, শ্বেত রক্তকণিকা বা পাস সেল ইত্যাদির উপস্থিতি। মল অ্যাসিডিক না অ্যালকালাইন সেটাও দেখা হয়।
মলের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত থাকে। তবে ইনফেকশন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করার জন্য মলের কালচার নামক অন্য একটি পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয়।
কেন মলের RE পরীক্ষা করা হয় ? Why is stool RE tested?
পরিপাক নালি, পরিপাক গ্রন্থি অর্থাৎ যকৃত, অগ্নাশয় ইত্যাদি রোগাক্রান্ত হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়। অগ্নাশয় নি:সৃত কিছু উৎসেচকের কার্যকারিতা বোঝার জন্য এই টেস্ট করা হয়। পৌষ্টিকতন্ত্র সম্পর্কিত কোন রোগ লক্ষণ দেখা গেলে, যেমন দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া হলে, রক্ত মিশ্রিত ডায়রিয়া হলে, পেটে অতিরিক্ত পরিমাণ গ্যাস উৎপন্ন হলে অর্থাৎ পেট ফুলে গেলে, ক্ষুধা মন্দা হলে, বমি পেলে, পেটে ব্যথা হলে, পেটে খিঁচুনি হলে, বা পেট খারাপের সাথে সাথে জ্বর হলে মল পরীক্ষা করতে হয়। কলন ক্যান্সার বা পৌষ্টিকতন্ত্রে আলসার হলে, সেখান থেকে রক্ত ক্ষরিত হচ্ছে কিনা, সেটা বিশেষ ধরনের মল পরীক্ষা, অকাল্ট ব্লাড টেস্ট নামক পরীক্ষার সাহায্যে সনাক্ত করা হয়।
পেটের মধ্যে কৃমির বসবাস করছে কিনা, সেটা জানার জন্য মল পরীক্ষা সর্বাপেক্ষা ভালো। ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, ভাইরাস ইত্যাদি সনাক্ত করার জন্যও মল পরীক্ষা করতে হয়। এছাড়া অপুষ্টি-জনিত রোগে মল পরীক্ষা করলে, পোষ্টিকতন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
মলের রুটিন পরীক্ষার আগের প্রস্তুতি। Preparation before routine examination of stool.
বেশকিছু ওষুধ আছে যা পরীক্ষার ফলাফল কে প্রভাবিত করতে পারে। ডাক্তারবাবু এবং ল্যাবরেটরিতে কি কি ওষুধ সেবন করছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিন। কিছু ওষুধ আছে যেগুলি এক থেকে দুই সপ্তাহ না খেয়ে তারপর মলের রুটিন টেস্ট করা উচিত। যেমন অ্যান্টাসিড, অ্যান্টি ডায়রিয়াল মেডিসিন, কৃমি নাশক মেডিসিন, মলত্যাগে সাহায্যকারী ওষুধ ইত্যাদি। যদি কয়েকদিন আগে বেরিয়াম নামক পদার্থ খেয়ে এক্স-রে করে থাকেন বা বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ল্যাবরেটরিতে এই তথ্যটি জানান। মহিলাদের পিরিয়ড চলাকালীন মল পরীক্ষা করা উচিত নয়।
মল RE টেস্টের জন্য মলের নমুনা সংগ্রহ। Collection of stool sample for stool RE test.
মলের নমুনা বাড়িতে, ল্যাবরেটরিতে অথবা হাসপাতালে সংগ্রহ করা যেতে পারে। সাধারণত একটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে পরপর তিনদিন মলে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। মলের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য ল্যাবরেটরি থেকে বিশেষ ধরনের জীবাণুমুক্ত পাত্র নিয়ে আসতে হয়। সেটা সম্ভব না হলে প্লাস্টিক বা কাচের ছোট পাত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মলের কালচার নামক পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরি থেকেই পাত্র আনতেই হবে, অন্য কোন পাত্র ব্যবহার করা চলবে না। কারণ ল্যাবরেটরি থেকে সংগ্রহ করা পাত্রটি স্টেরিলাইজড অর্থাৎ জীবাণুমুক্ত করা থাকে।
মলের রুটিন টেস্ট করার জন্য মলের নমুনা সংগ্রহ করার পদ্ধতি। Methods of collecting stool samples for routine stool testing.
প্রথমে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। এবার মূত্র ত্যাগ করতে হবে। এর ফলে মলের নমুনায় মূত্র মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা কমবে। এবার পাত্রের ঢাকনা খুলে মল সংগ্রহ করতে হবে। মাত্র পাঁচ-গ্রাম মল রুটিন পরীক্ষা করার জন্য যথেষ্ট। অতিরিক্ত পরিমাণ মল সংগ্রহ করবেন না। মলের প্রকৃতি কঠিন তরল, যেমনই হোক, সংগ্রহ করার পর ঢাকনা বন্ধ করতে হবে। ডায়রিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে বা বিছানা-গত রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক নির্মিত বিশেষ ধরণের মূল সংগ্রহ করার ব্যাগ ব্যবহার করে মল সংগ্রহ করতে হবে। এবার এই ব্যাগটিকে একটি প্লাস্টিক পাত্রের মধ্যে সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে।
কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীদের যাদের সহজে মল নির্গত হয় না তাদের, সামান্য পরিমাণে ডুস দেওয়া যেতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়াপারের মধ্যে থাকা মল সংগ্রহ করা যেতে পারে। তবে তার মধ্যে যেন মূত্র মিশে না থাকে। মলে মোট চর্বি জাতীয় পদার্থ পরিমাপ করার জন্য টানা ৩ দিন মূল সংগ্রহ করা হবে, এক্ষেত্রে বড় পাত্র ব্যবহার করতে হবে এবং পাত্রটি কে রেফ্রিজারেটর এর মধ্যে সংরক্ষণ করতে হবে।
পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা। Interpretation of test results.
মলের নমুনা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলি পরীক্ষা করা হয়। মনে রাখবেন পরীক্ষার ফলাফল পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষাগার এবং স্থান অনুসারে পরিবর্তনশীল। সে কারণে আপনার রিপোর্টে যে স্বাভাবিক মান লেখা থাকবে অর্থাৎ যে নরমাল রেঞ্জ দেওয়া আছে, সেটা মেনে চলা সবথেকে ভালো। ল্যাবরেটরি রিপোর্টের সাথে শারীরিক রোগ লক্ষণ মিলিয়ে ডাক্তার বাবু সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।
ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন। Physical examination.
প্রথমেই দেখা হয় মলের রং ও গন্ধ। স্বাভাবিক মলের রং হালকা থেকে ঘন হলদে বাদামি হয় এবং ঘন আকার যুক্ত হয়। রোগী কি ধরনের খাবার খেয়েছে তার উপর মলের রঙের বদল ঘটতে পারে। অস্বাভাবিক মলের রং হলদে সবুজ কাদার মত, লালচে চকলেট এর মত হতে পারে। এমন কি হলদে সাদা ও হতে পারে। তরল ও অর্ধ-তরল মল অস্বাভাবিক। পৌষ্টিকতন্ত্রে রক্তপাত হলে কালচে রঙের মল সৃষ্টি হয়। অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস হলে মলের রং বর্ণহীন হয়। ডায়রিয়া রোগীদের মল পাতলা ও পচা গন্ধযুক্ত হয়। পেটে অতিরিক্ত অ্যাসিড সৃষ্টি হলেও পাতলা গন্ধযুক্ত মলের সৃষ্টি হয়। যাদের মল জলে ভেসে ওঠে, তাদের তাদের ক্ষেত্রে মলের মধ্যে ফ্যাট জাতীয় পদার্থের পরিমাণ বেশি আছে। অতিরিক্ত ফ্যাট থাকাও অস্বাভাবিক বলেই মনে করা হয়। মল পরীক্ষার রিপোর্টে গন্ধেরও উল্লেখ করা থাকে। উগ্র গন্ধযুক্ত মল স্বাভাবিক নয়।
এরপর দেখা হয় মলের মধ্যে দৃশ্যমান রক্ত আছে কিনা। রক্ত থাকা স্বাভাবিক নয়। পৌষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে রক্তক্ষরণ ঘটলে এটা দেখা যেতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় রক্ত এমন ভাবে মিশে থাকে যে, মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা সম্ভব হয় না। পৌষ্টিকতন্ত্রের গভীরে রক্ত ক্ষরণ হলে সেটা মাইক্রোস্কোপেও দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে অকাল্ট ব্লাড টেস্ট নামক পরীক্ষা করলে সহজেই বোঝা যায় রক্তক্ষরণ হয়েছে কিনা। অকাল ব্লাড টেস্ট পজিটিভ হলে বুঝতে হবে যে, পোষ্টিকতন্ত্রে মধ্যে কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এছাড়া মলের মধ্যে কতটা মিউকাস বা শ্লেষ্মা আছে সেটাও রিপোর্টে উল্লেখ করা থাকে। সাধারণত মিউকাস মলের সাথে ভালোভাবে মিশে থাকে। কিন্তু মলের মধ্যে স্পষ্টভাবে পাস সেল-যুক্ত মিউকাস পাওয়া গেলে বুঝতে হবে রোগী, ক্ষত যুক্ত কোলাইটিস বা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ডায়রিয়াতে আক্রান্ত।
মাইক্রোস্কোপিক এক্সামিনেশন। Microscopic examination
সামান্য একটু মল স্যালাইনের সাথে মিশিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করতে হয়। এই পরীক্ষা করা হয় পেটের মধ্যে কোন প্যারাসাইট অর্থাৎ কৃমি আছে কিনা সেটা জানার জন্য। মলে অতিরিক্ত পরিমাণ হজম না হওয়া খাদ্য কণা থাকলেও বুঝতে হবে হজমের কোন সমস্যা হচ্ছে। মলের মধ্যে বেশি পরিমাণ চর্বি উপস্থিত থাকলেও এই পরীক্ষার সাহায্যে সনাক্ত করা সম্ভব। কোন ধরনের ক্রিমি বা প্রটোজোয়া পেটে বাসা বেধেছে, সেটা স্পষ্টভাবে মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমেই বলা সম্ভব।
যে সকল পরজীবীদের ডিম মলের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে সেগুলি হল; অ্যাসকারিস বা গোল কৃমি, হুক ওয়ার্ম, ফিতা কৃমি ইত্যাদি। আলসারেটিভ কোলাইটিস ও ব্যসিলারি ডিসেন্ট্রিতে মলে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া ও পাস সেল দেখা যায়।
মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষার সময় মলের মধ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ ফ্যাট উপস্থিত আছে কিনা, সেটা দেখার জন্য মলের নমুনার সাথে সুদান III নামক রং ব্যবহার করা হয়। মলে অতিরিক্ত ফ্যাটের উপস্থিতিকে স্টিয়েটোরিয়া (Steatorrhea) বলা হয়। অগ্নাশয়ে সিস্ট বা টিউমার হলে, অন্ত্রে খাদ্যবস্তু শোষণে কোন সমস্যা হলে, এই অবস্থা হতে পারে।
মনের মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকা আছে কিনা সেটা মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করার সময় দেখা যায়। কোলন, মলাশয় এবং মলদ্বারে কোনও ক্ষত সৃষ্টি হলে, মলের মধ্যে RBC অর্থাৎ লোহিত রক্ত কণিকা পাওয়া যায়। আমাশয় রোগে গুচ্ছ গুচ্ছ RBC দেখতে পাওয়া যায়।
মলে অল্প কয়েকটি শ্বেত রক্ত কণিকা অর্থাৎ পাস সেল থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বেশি পরিমাণে পাস সেল থাকা অস্বাভাবিক। ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ডায়রিয়াতে পৌষ্টিকতন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হলে বা ইনফেকশন হলে পাস সেলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
মলের মধ্যে ক্রিস্টাল বা কেলাস থাকতে পারে। চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর ফ্যাটি অ্যাসিডের ক্রিস্টাল থাকা খুবই স্বাভাবিক। এছাড়া মলে ট্রিপল ফসফেট, ক্যালসিয়াম অক্সালেট ইত্যাদি ক্রিস্টাল থাকতে পারে। এই সকল ক্রিস্টালের উপস্থিতির তেমন কোন গুরুত্ব নেই। কিন্তু চারকট লেডন ক্রিস্টালের উপস্থিতিকে কোন কোন বিজ্ঞানী যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। ক্ষুদ্রান্তে আলসার বা প্রদাহ সৃষ্টি হলে এই ধরনের ক্রিস্টাল পাওয়া যেতে পারে। পৌষ্টিকতন্ত্রে রক্তপাত ঘটলে হেমাটয়ডিন নামক ক্রিস্টাল পাওয়া যেতে পারে।
কেমিক্যাল এক্সামিনেশন। Chemical Examination
মলের রাসায়নিক পরীক্ষার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলও অকাল্ট ব্লাড টেস্ট। এই টেস্টের সাহায্যে পৌষ্টিকতন্ত্রের মধ্যে রক্তপাত হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
এছাড়া মলের মধ্যে অতিরিক্ত ফ্যাট আছে কিনা সেটা একটি বিশেষ রাসায়নিক পরীক্ষার সাহায্যে বোঝা যায়।