Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রারোগ ও ব্যাধি Health Condition

রিং-ওয়ার্ম বা দাদ: কারণ, রোগ-লক্ষণ ও চিকিৎসা। Ringworm: Cause, Symptoms and Treatment:

রিং-ওয়ার্ম বা দাদ একটি সাধারণ ছত্রাকের সংক্রমণ। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এই সংক্রমণ প্রভাবিত করে। নাম রিং-ওয়ার্ম হলে এটা কোন ওয়ার্ম বা কৃমির সংক্রমণ নয়।

এই প্রতিবেদনে রিং-ওয়ার্ম বা দাদের কারণ, রোগ-লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এটা হল ছত্রাকের সংক্রমণ। রিং-ওয়ার্ম এর সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট ক্ষতটি দেখতে অনেকটা রিং-এর আকারের  কৃমির মত, তাই এর নাম রিং-ওয়ার্ম বা দাদ। প্রধানত Tinea নামক ছত্রাকের সংক্রমণে এই ধরনের ক্ষত তৈরি হয়। তবে প্রায় 40 প্রকার বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক এই ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। ছত্রাক গুলি ত্বকের বাইরের স্তরে সংযুক্ত হয়ে গেলে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলে চুলকানি হয় এবং আঁচড় দিলে ত্বকের আরও ক্ষতি হয় ও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।

শরীরের বিভিন্ন অংশে দাদ হতে পারে। কোন স্থানে দাদ হয়েছে তার উপর নির্ভর করে দেখতে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।

টিনিয়া কর্পোরিশ (Tinea corporis)  নামক ছত্রাক আমাদের দেহের বিভিন্ন অংশের ত্বকে দাদ সৃষ্টি করতে পারে। কাঁধ, ঘাড়, পেট, হাত পা ইত্যাদি স্থানে সংক্রমণ ঘটে। ত্বকের সংক্রমণ হলে লাল রঙের রিং-এর আকারের ক্ষত সৃষ্টি হয়।

টিনিয়া ক্যাপিটিস (Tinea capitis) আমাদের মাথার ত্বকে দাদ সৃষ্টি করে। মাথার ত্বকে আঁশযুক্ত দাগ হয়ে যায় ও চুলকায়। আক্রান্ত স্থানের চুল উঠে যায়। এটা শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

টিনিয়া বারবি (Tinea barbae) আমাদের গাল, চিবুক, ঘাড় এবং মাথার ত্বকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এটা দেখতে সাধারণ ব্রণ বা অন্য কোন ত্বকের রোগের মত মনে হয়। এছাড়া লিম্ফনোড ফুলে যেতে পারে ও ক্লান্তির অনুভূতি হতে পারে।

টিনিয়া ম্যানুয়াম (Tinea manuum) নামক ছত্রাক হাতের তালুতে সংক্রমণ ঘটায়। আঙ্গুলের ফাঁকে বা হাতের পিছনে রিং আকৃতির সংক্রমণ দেখা যেতে পারে।

টিনিয়া ক্রুরিস (Tinea cruris) নামক ছত্রাক উরু, নিতম্ব, কুঁচকি ইত্যাদি স্থানে সংক্রমণ ঘটায়। এটি পুরুষ এবং কিশোরদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। ত্বক চুলকায় ও লাল, বাদামি বা ধূসর ফুসকুড়ির মতো বেড় হয়। ব্যায়াম করার পর চুলকানির মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। সাধারণ স্টেরয়েড ক্রিম লাগিয়ে তেমন কোন লাভ হয় না, উল্টে বেড়ে যায়।

পায়ে দাদের সংক্রমণ ঘটায় টিনিয়া পেডিস (Tinea pedis) নামক ছত্রাক। যারা খালি পায়ে হাঁটেন, তাদের এটা বেশি হয়। খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, বাথরুম ইত্যাদি স্থান থেকে এই ধরনের সংক্রমণ ঘটে। পায়ের আঙুলের মধ্যে সংক্রমণ শুরু হয় এবং গোড়ালিতে ছড়িয়ে পড়ে। সংক্রমিত স্থানে চুলকানি হয়, জ্বালাপোড়া, ফোসকা, ত্বকের খোসা ছেড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।

নখের মধ্যে টিনিয়া আংগুইয়াম (Tinea unguium) নামক ছত্রাকের সংক্রমণ হতে পারে। পায়ের নখে সংক্রমণ বেশি হয়, তবে হাতেও হতে পারে। আক্রান্ত নখ মোটা হয়ে যায়, রং বিবর্ণ হয়ে যায়। এমনকি নখ ফেটে যেতে পারে বা উঠে যেতে পারে।

বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক আমাদের দেহে দাদের সৃষ্টি করতে পারে। ছত্রাক বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে বসবাস করে। এমনকি আমাদের ত্বকেও বাস করতে পারে। দাদ খুবই সংক্রামক রোগ। দাদ আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যেমন চিরুনি, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যবহার করলেে দাদের সংক্রমণ হতে পারে। শিশুদের মধ্যে সাধারণত এভাবেই সংক্রমণ ঘটে।

কোন পোষ্য প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির দেহ থেকেও দাদের সংক্রমণ ঘটতে পারে। সাধারণের ব্যবহার্য বস্তু যেমন টেলিফোন, কিবোর্ড, বাথরুম ইত্যাদি থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া ছত্রাক যুক্ত মাটি থেকেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হলে রিং-ওয়ার্মের সংক্রমণ সহজে ঘটে। একারণে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি দেখা যায়।

দাদ রোগ নির্ণয় করার প্রধান পদ্ধতি হল শারীরিক পরীক্ষা। সংক্রমিত স্থান ভাল করে নিরীক্ষণ করে রোগ সনাক্ত করা যায়। কখনও কখনও বিশেষ ধরনের আলো ব্যবহার করে সংক্রমিত স্থান পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। অনেক সময় নিশ্চিত ভাবে রোগ সনাক্ত করার জন্য ত্বকের বায়পসি করার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে ত্বকের উপরের অংশ চেঁচে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ছত্রাক কালচার করার মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করা যায়।

দাদ সাধারণত নিজে নিজে ভালো হয় না। একারণে দাদের চিকিৎসা করার জন্য ওষুধ ব্যবহার করা হয়। সংক্রমিত স্থানে লাগানোর জন্য অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম, লোশন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ খাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে।

রিং-ওয়ার্ম সংক্রমণের তীব্রতা ও কোন স্থানে আক্রমণ করেছে তার উপর চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ভর করে। শরীর, কুঁচকি, হাত, মুখ ইত্যাদি স্থানে সংক্রমণ হলে অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্লেট্টিমাজোল (Clotrimazole) মাইকোনাজোল (Miconazole) ইত্যাদি ক্রিম ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়।

জক চুলকানির রোগীদের কুঁচকির স্থান পরিষ্কার ও শুকনো রাখা উচিত। সুতির অন্তর্বাস পরা উচিত। পায়ে অ্যাথলেট ফুট নামক সংক্রমণ, সাধারণ অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম ব্যবহার করলে সেরে যায়। তবে সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে, ইট্রাকোনাজোল (Itraconazole) ফ্লুকোনাজোল (Fluconazole) ইত্যাদি ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হয়।

মাথার ত্বকে বা দাঁড়িতে দাদের সংক্রমণ হলে অ্যান্টিফাঙ্গাল শ্যাম্পু যেমন ক্লেট্টিমাজোল (Clotrimazole), কিটোকোনাজোল (Ketoconazole), সেলিনিয়াম সালফাইড (Selenium Sulphide)ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। সঙ্গে প্রয়োজন হলে গ্রিজিওফুলভিন (Griseofulvin) জাতীয় অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ সেবন করতে হয়।

নখের সংক্রমণের চিকিৎসা করা বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে ইট্রাকোনাজোল (Itraconazole) ক্রিম ব্যবহার করার সাথে ইট্রাকোনাজোল (Itraconazole) খাওয়ারও দরকার পড়ে।

দাদের চিকিৎসা করার জন্য প্রাথমিক অবস্থায় স্টেরয়েড যুক্ত সাধারণ ক্রিম ব্যবহার করা উচিত নয়। এটা দাদের সংক্রমণকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে।

স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অনুসরণ করলে দাদের সংক্রমণ এড়িয়ে চলা সম্ভব। কোন পোষ্য প্রাণীকে স্পর্শ করার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। পোষ্য প্রাণীর বাসস্থান জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার রাখতে হবে। পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করলে জুতো পড়ে হাঁটতে হবে। অন্য কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বস্তু যেমন চিরুনি, তোয়ালে, পোশাক ইত্যাদি ব্যবহার করা চলবে না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অন্তর্বাস পরিধান করতে হবে। খেলাধুলার সাজ সরঞ্জাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিজের ত্বক পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা দরকার। পাবলিক টয়লেট বা সুইমিং পুল কম ব্যবহার করতে হবে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নতি করার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে এবং শরীর চর্চা করতে হবে।