পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট: Postprandial Blood Sugar Test:
রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ অর্থাৎ ব্লাড সুগারের পরিমাণ সঠিক আছে কিনা জানার জন্য যে পরীক্ষাগুলি করা হয় তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট। খাদ্য গ্রহণ করার পর এই রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কি নিয়ম মেনে, কতটা পরিমাণ খাদ্যগ্রহণ করে পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা উচিত সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে, কোন ব্যক্তি কী ধরনের ডায়াবেটিসে ভুগছেন সেটা সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত ভরপেটে খাদ্য গ্রহণ করার ঠিক 2 ঘণ্টা পর রক্তে গ্রহণ করে তার মধ্যে গ্লুকোজ বা সুগারের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়।
দুপুরে ও রাত্রে আমরা ভরপেট খাদ্য গ্রহণ করে থাকি। খাদ্য গ্রহণ করার কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রের অগ্নাশয় গ্রন্থি ইনসুলিন নামক হরমোন উৎপাদন করে এবং রক্তশর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। যাদের ডায়াবেটিস হয়েছে তাদের দেহে ইনসুলিন কম উৎপাদিত হয় বা ইনসুলিন পর্যাপ্ত পরিমাণে কাজ করতে পারে না। ফলে রক্তের মধ্যে গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা বেশি থাকে। দীর্ঘদিন ধরে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে চোখ, স্নায়ুতন্ত্র, বৃক্ক বা কিডনি, রক্তজালক ইত্যাদি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কখন পরীক্ষা করবেন? When to get tested PP Blood Sugar?
ডায়াবেটিস হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকলে অথবা আপনার বয়স 45 এর বেশি হলে অবশ্যই পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
ব্লাড সুগার বেশি বা কম হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলে পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা উচিত।
আপনার ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ওষুধ খেলে রক্ত শর্করা কতটা নিয়ন্ত্রণে আছে জানার জন্য ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা দরকার।
গর্ভবতী মায়েদের গর্ভধারণে সময় ডায়াবেটিস হতে পারে। এই গ্যাসটেশনাল ডায়াবেটিস সনাক্ত করতে পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট করা উচিত।
রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিন শুরু করার আগে ও পরে ইনসুলিনের ডোজের পরিবর্তন করার সময় এই টেস্ট করা প্রয়োজন।
যারা একসাথে অনেকগুলি ওষুধ খাচ্ছেন, তাদের পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগার টেস্ট করে, দেহে সুগারের কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা সেটা জেনে নেওয়া ভাল।
পরীক্ষার আগের প্রস্তুতি: Preparation before testing PP Blood Sugar:
পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা দেওয়ার 2 ঘন্টা আগে 75 গ্রাম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত দুপুরের স্বাভাবিক খাদ্য যেমন ভাত, ডাল, তরকারি বা রুটি, সবজি ইত্যাদি গ্রহণ করা ভাল। কোন কারণে খাদ্য গ্রহণ করা সম্ভব না হলে 75 গ্রাম গ্লুকোজ খেয়েও এই পরীক্ষা করা যেতে পারে। যে সময় খাদ্য গ্রহণ করা শেষ হয়, ঠিক তার 2 ঘন্টা পর রক্তের নমুনা নেওয়া উচিত।
অনেক সময় এই পরীক্ষার জন্য খাদ্য গ্রহণ করার আগে 12 ঘন্টা অনাহারে থাকতে বলা হয়। তবে গর্ভবতী মহিলাদের অনাহারে থাকা নিষেধ।
বর্তমানে কোন কোন ওষুধ গ্রহণ করছেন, সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন ওষুধ খেয়েছেন কিনা এবং কোন পরিপূরক খাদ্য গ্রহণ করেন কিনা, সেটা ল্যাবরেটরিতে এবং আপনার চিকিৎসককে জানান।
কিভাবে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়? How is the blood sample collected for PP Blood Sugar test?
সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। বাহুতে একটি রাবার ব্যান্ড দ্বারা বাঁধন দেওয়া হয় এবং সিরিঞ্জের সাহায্যে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
আঙুলে সূচ বিদ্ধ করেও রক্ত সংগ্রহ করা যেতে পারে। পোর্টেবল গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্ত পরীক্ষা করলে, আঙুলে সূচবিদ্ধ করে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় গোড়ালিতে সূচবিদ্ধ করে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।
বাড়িতে পোর্টেবল গ্লুকোমিটারের সাহায্যে রক্ত পরীক্ষা করা উপেক্ষা ল্যাবরেটরিতে রক্ত পরীক্ষা করা বেশি ভাল।
পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা: Interpretation of PP Blood Sugar test results:
পরীক্ষার ফলাফল বয়স, লিঙ্গ, পরীক্ষা পদ্ধতি এবং রোগীর স্বাস্থ্যের ইতিহাসের উপর পরিবর্তনশীল।
পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগারের নরমাল লেভেল সাধারণত মিলিগ্রাম/ ডেসিলিটার হিসাবে অথবা মিলিমোল/লিটার হিসাবে প্রকাশ করা হয়।
পোস্টপ্যারেনডিয়াল ব্লাড সুগারের মাত্রা 140 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার অর্থাৎ 7.8 মিলিমোল/লিটার পর্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়।
রক্ত সুগারের মাত্রা 140 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার থেকে 199 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার অর্থাত 7.8 মিলিমোল/লিটার থেকে 11.0 মিলিমোল/লিটার এর মধ্যে হলে প্রিডায়াবেটিস অবস্থা অর্থাৎ ডায়াবেটিসের ঠিক আগের মুহূর্ত বলে মনে করা হয়।
রক্তে সুগারের পরিমাণ 200 মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার এর বেশি হলে অর্থাৎ 11.1 মিলিমোল/লিটার এর বেশি হলে, ডায়াবেটিস হয়েছে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
রক্ত গ্লুকোজ বা সুগারের মাত্রা বৃদ্ধিকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। যে রোগে এই অবস্থা হয় তাকে ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিস ছাড়াও বেশ কিছু রোগে রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অ্যাক্রোমেগালি (Acromegaly) নামক রোগে, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হলে, দীর্ঘদিন ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগলে, কুশিং এর সিনড্রোমে, থাইরয়েড গ্রন্থি বেশি সক্রিয় হয়ে উঠলে, অগ্নাশয়ে ইনফেকশন হলে বা ক্যান্সার হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে তাকে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলা হয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলি হল; ঘাম হওয়া, বুক ধরফর করা, খিদে পাওয়া, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। রক্তে সুগারের মাত্রা খুব বেশি কমে গেলে, রোগীর মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না, রোগী কমায় চলে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
যে সকল রোগী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইনসুলিন গ্রহণ করছেন বা চিকিৎসা করাচ্ছেন, তাদের ওষুধের ওভারডোজ হলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। একারণে ডায়াবেটিস এর চিকিৎসা করার সময় খুব সাধারণ সাবধান থাকতে হয়।
বেশ কিছু রোগে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা যায়; যেমন অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি কম কাজ করলে, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করলে, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হলে এবং থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা হ্রাস পেলে।
এছাড়া দেহে তীব্রমাত্রায় ইনফেকশন হলে, হার্টের সমস্যা হলে, অনশন করলে, রেনাল ফেলিওর হলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে যায়।