কোলাজেন বৃদ্ধির 10টি বৈজ্ঞানিক উপায়। 10 Scientific Ways to Boost Collagen.
আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা ও তারুণ্য রক্ষা করে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন যার নাম কোলাজেন। এটি আমাদের ত্বককে দৃঢ়, মসৃণ ও স্থিতিস্থাপক রাখে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোলাজেনের উৎপাদন কমতে থাকে। এর ফলে ত্বকে বলিরেখা দেখা দেয়, ত্বক ঝুলে পড়ে ও বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা যায়। কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে ত্বক স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল হতে পারে।
এই প্রতিবেদনে কোলাজেন বৃদ্ধির 10টি বৈজ্ঞানিক উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
কোলাজেন কী? What is Collagen?
কোলাজেন হল একটি তন্তু জাতীয় প্রোটিন যা আমাদের ত্বকের গঠনের 75 শতাংশ তৈরি করে। এটি আমাদের ত্বকের প্রধান বুনিয়াদ। কোলাজেন পেশি, হাড়, টেন্ডন, রক্তনালী, পৌষ্টিকতন্ত্র ইত্যাদি সহ অসংখ্য টিস্যুতে উপস্থিত থাকে। এটি ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে ও শরীরের কাজ স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোলাজেনের মাত্রা কমে গেলে আমাদের স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোলাজেনের উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পায়। কোলাজেনের অভাব হলে স্কার্ভি, রক্তাল্পতা, দুর্বলতা, ক্ষত নিরাময়ে দেরি হওয়া, হাড় দুর্বল হয়ে পড়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় কোলাজেনের ভূমিকা: The role of collagen in maintaining skin health:
কোলাজেনের মাত্রা স্বাভাবিক বা বেশি থাকলে ত্বক নরম, মসৃণ ও দৃঢ় থাকে। কোলাজেনের মাত্রা ও গুণমান উভয়ই ত্বকের উপর প্রভাব ফেলে। ত্বকের কোষগুলির পুনর্নবীকরণ ও মেরামতে সাহায্য করে কোলাজেন।
কোলাজেনের উৎপাদন কমে গেলে বা গুণমান হ্রাস পেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা কমে যায়, ত্বক শিথিল হয়ে পড়ে ও বলিরেখা দেখা দেয়। আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোলাজেনের গঠনে পরিবর্তন ঘটে, ফলে ত্বকের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বন্ধন দুর্বল হয়ে যায়। একারণে ত্বকের মধ্যে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়।
কোলাজেন বৃদ্ধির বৈজ্ঞানিক উপায়: Scientific ways to increase collagen:
ভিটামিন C গ্রহণ: Taking vitamin C:
ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য ভিটামিন C কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই খাদ্য তালিকায় ভিটামিন C যুক্ত খাদ্য যোগ করতে হবে। অ্যামাইনো অ্যাসিডকে কোলাজেনে রূপান্তরিত করতে ভিটামিন C এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু জাতীয় ফল, স্ট্রবেরি, কাঁচা লঙ্কা, আমলকী, কমলা, টমেটো, পেয়ারা ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাবার কোলাজেনের উৎপাদন বাড়ায় ও ত্বকের তারুণ্য রক্ষা করে।
প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ: Eating protein-rich foods:
খাদ্য তালিকায় প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, কারণ কোলাজেন প্রোটিন দিয়ে তৈরি। প্রাকৃতিকভাবে কোলাজেনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে ডিম, মাছ, চর্বিহীন মাংস, মটরশুঁটি, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। এগুলি কোলাজেন তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড সরবরাহ করে। জিংক এবং কপার সমৃদ্ধ খাদ্যগুলিও কোলাজেন গঠনে সাহায্য করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ: Eating foods rich in antioxidants:
বিপাক ক্রিয়ায় উৎপন্ন ক্ষতিকর ফ্রি রেডিক্যালের হাত থেকে রক্ষা করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অক্সিডেটিভ ট্রেসের বিরুদ্ধে সবথেকে ভালো প্রতিরোধ গড়ে তোলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ব্লু-বেরি, ডার্ক চকলেট, পালং শাক, বেদানা, দারচিনি, তুলসী, কফি ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়। এছাড়া গ্রিন টি তে থাকা পলিফেনল কোলাজেনের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ: Taking collagen supplements:
উচ্চ কোলাজেন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করার সাথে সাথে কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে বেশ ভালো উপকার পাওয়া যায়। উচ্চমানের কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট, হাইড্রোলাইজ কোলাজেন পেপটাইড দিয়ে তৈরি। এই ধরনের কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট পৌষ্টিকতন্ত্রে সহজে শোষিত হয় ও প্রাকৃতিক কোলাজেন উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতির সাথে সাথে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায় ও বলিরেখা কমে। সাপ্লিমেন্ট নির্বাচন করার সময় টাইপ I ও টাইপ III কোলাজেন পেপটাইডযুক্ত সাপ্লিমেন্ট বেছে নিন, কারণ এগুলি ত্বক, চুল ও নখের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী। এছাড়া সাপ্লিমেন্টের মধ্যে ভিটামিন C হায়ালুরোনিক অ্যাসিড, বায়োটিন ইত্যাদি উপাদান থাকা উচিত।
রেটিনল ও অন্যান্য ক্যারোটিন গ্রহণ: Taking retinol and other carotenes:
ক্যারোটিনয়েড যেমন রেটিনল এবং বিটা ক্যারোটিন হল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, রেটিনল ও অন্যান্য ক্যারোটিনয়েড সূর্যালোকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং কোলাজেনের ভেঙে যাওয়া রোধ করে।
মিষ্টি আলু, পালং শাক, কুমড়ো, গাজর ইত্যাদির মধ্যে রেটিনল পাওয়া যায়। রেটিনলযুক্ত ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করলে ত্বকের গঠনের উন্নতি হয়।
ত্বককে রক্ষা করা: Protecting the skin:
কোলাজেন নষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ। দীর্ঘক্ষণ সূর্যালোকে থাকলে কোলাজেন নষ্ট হতে পারে, ফলে ত্বকের দৃঢ়তা ও স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। সূর্যের আলো থেকে ত্বককে রক্ষা করার জন্য সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করতে হবে এবং শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পড়তে হবে।
ধূমপান বন্ধ করা উচিত কারণ তামাকে থাকা রাসায়নিক গুলি কোলাজেনের উৎপাদনে বাধা দেয়। অতিরিক্ত ক্যাফিনও শরীরের কোলাজেন উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। তাই অতিরিক্ত ক্যাফিন গ্রহণ করা উচিত নয়।
ওমেগা 3 ফাটি অ্যাসিড গ্রহণ: Taking Omega 3 Fatty Acids:
পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করতে হবে। সামুদ্রিক মাছ, চিয়া বীজ, আখরোট, আমন্ড, সয়াবিন ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। ত্বকের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বন্ধন শক্ত করতে ও কোলাজেন রক্ষা করতে ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এই ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ কমায়, ত্বকে মসৃণ রাখে ও ত্বকের তারুণ্য রক্ষা করে।
চিনি কম গ্রহণ: Reduce sugar intake:
ত্বক ভালো রাখতে চিনি গ্রহণের পরিমাণ সীমিত করতে হবে। অতিরিক্ত চিনি আমাদের দেহে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। চিনি আমাদের ত্বকের বয়স বাড়িয়ে দেয়। কোলাজেন ফাইবারের সাথে চিনি আবদ্ধ হয়ে কোলাজেনকে শক্ত করে তোলে, ফলে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় ও বলিরেখা দেখা দেয়। সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে ও চিনিযুক্ত খাবার কম খেলে কোলাজেন ভালো থাকে।
পর্যাপ্ত জলপান: Drinking enough water:
ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পর্যাপ্ত জল পান করতে হবে। জল ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে ফলে ত্বক তরুণ দেখায়। প্রতিদিন 2.5 থেকে 3 লিটার জল পান করলে ত্বক ভালো থাকে, আর্দ্র ও কোমল থাকে। দেহে জলের অভাব হলে ত্বক নিস্তেজ দেখায় এবং বলিরেখার পরিমাণ বেড়ে যায়।
লাইট থেরাপি: Light therapy:
লাল আলো বা অন্যান্য আলো ব্যবহার করে ত্বকের চিকিৎসা করলে কোলাজেন পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া লাইট থেরাপি বলিরেখা কমায় এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, লাল আলোর চিকিৎসায় দ্রুত কোলাজনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটি একটি নিরাপদ উপায় এবং বলিরেখা কমাতে ও ত্বকের বয়স কমাতে বেশ ভালো কার্যকরী। অনেক চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ লাইট থেরাপি প্রদান করেন, তবে বাড়িতেও এই থেরাপি গ্রহণ করা যায়।
তথ্যসূত্র:
MedicalNewsToday, Everyday Health, Healthline, Cleveland Clinic, Wellbeing Nutrition,