সি রিয়াকটিভ প্রোটিন রক্ত পরীক্ষা: C Reactive Protein Test:
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন রক্ত পরীক্ষা: C Reactive Protein Test:
আধুনিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সকল ব্যক্তিদের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তাদের মধ্যে 50 শতাংশ ব্যক্তিদের লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) বেশি ছিল। বাকি 50 শতাংশ ব্যক্তিদের এল ডি এল (LDL) বেশি না থাকা সত্ত্বেও হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। একারণে বর্তমানে চিকিৎসকরা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বিচার করতে এল ডি এল (LDL) এর সাথে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করতে দেন।
কি কি রোগ সনাক্ত করতে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করা হয়, টেস্টের আগে কি নিয়ম মেনে চলতে হয়, সেটা জানতে এই প্রতিবেদন পড়তে থাকুন।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট কি? What is C Reactive Protein Test?
লিভার অর্থাৎ যকৃত থেকে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন উৎপন্ন হয়। দেহের মধ্যে ইনফ্লামেশন অর্থাৎ প্রদাহ সৃষ্টি হলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) রক্তনালীর গহ্বর সংকীর্ণ করে দেয় এবং রক্তনালীর গায়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে। রক্তনালীর গায়ের এই প্রদাহ বা ইনফ্লামেশনকে সারিয়ে তুলতে আমাদের শরীর কিছু প্রোটিনকে কাজে লাগায়। সি রিয়াকটিভ প্রোটিন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট এর সাহায্যে রক্তের মধ্যে এই বিশেষ প্রোটিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা সেটা দেখা হয়। দেহে এই মুহূর্তে কোন তীব্র বা দীর্ঘকালীন প্রদাহ অর্থাৎ ইনফ্লামেশন আছে কিনা সেটা এই টেস্টের সাহায্যে বোঝা যায়।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের উৎপাদন খুবই স্পর্শকাতর। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দেহের মধ্যে কোন আঘাত লাগলে, কোন ইনফেকশন হলে বা কোন প্রদাহ অর্থাৎ ইনফ্লামেশন হলে, সি রিয়াকটিভ প্রোটিন উৎপাদিত হয়।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট কেন করা হয়? Why is C Reactive Protein tested?
দেহের মধ্যে কোথাও প্রদাহ অর্থাৎ ইনফ্লামেশন আছে কিনা, সেটা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়। শরীরে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে কিনা জানার জন্য, ফুসফুস, মূত্রনালি, পৌষ্টিকতন্ত্র, ত্বক ইত্যাদি অঙ্গে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে কিনা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়। ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হলে আক্রমণ কোন পর্যায়ে আছে সেটা বোঝার জন্য সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করা হয়। দেহে ভাইরাসের আক্রমণ হলে বা ফাঙ্গাসের আক্রমণ হলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করে ধারণা পাওয়া যায়।
কিছু রোগ যেমন ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ, আর্থ্রাইটিস এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিকতা জনিত রোগে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন বৃদ্ধি পায়। লিউপাস, ভাসকুলাইটিস ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় করাকালীন চিকিৎসায় অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা পেতে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করা হয়।
সদ্যজাত শিশুদের সেপসিস হয়েছে কিনা জানতে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করার দরকার হয়। রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতিরিক্ত তীব্র মাত্রায় প্রতিক্রিয়া করলে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে জীবনহানি-কার অবস্থা সৃষ্টি হলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করা হয়।
অপারেশনের পর রোগীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে কিনা, ক্ষতস্থানে কোন জীবাণুর আক্রমণ হয়েছে কিনা জানতে এই টেস্ট করা হয়। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার পর দাতার কিডনি গ্রহীতার শরীর বর্জন করছে কিনা সেটা সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করে সহজেই জানা যায়।
দেহে ইনফেকশন আছে কিনা সেটা জানার আরেকটি পরীক্ষা হল ই এস আর (ESR) পরীক্ষা। ই এস আর টেস্টের সাথে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করতে দেওয়া হতে পারে। সেপসিস সনাক্তকারী পরীক্ষা প্রোক্যালসিটোনিন (Procalcitonin) পরীক্ষার সাথে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করতে দেওয়া হয়। তবে এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট কোন নির্দিষ্ট রোগ সনাক্তকারী পরীক্ষা নয়। বিভিন্ন কারণে এই পরীক্ষা করতে দেওয়া হতে পারে।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন এবং হার্টের রোগ: C Reactive Protein and Heart Disease:
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, শরীরে কোন প্রদাহ সৃষ্টি হলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। মাত্রাতিরিক্ত এল ডি এল (LDL) আমাদের রক্ত নালীর মধ্যে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ এল ডি এল (LDL) এর মাত্রা পরিমাপ করার সাথে সাথে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা পরিমাপ করলে হার্টের রোগের সম্ভাবনা কতটা আছে সেটা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন এর মাত্রা 2 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (2 mg/L) বেশি হলে হার্টের স্বাস্থ্য গুরুত্ব-পূর্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। হার্ট অ্যাটাকের পর সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে হার্টের চিকিৎসায় আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্টের জন্য কিভাবে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়? How is the blood sample collected for C Reactive Protein Test?
রক্ত সংগ্রহ করার আগে কোন বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। খালি পেটে বা খাদ্য গ্রহণ করার পর রক্ত দেওয়া যায়। সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে ত্বকের উপর অ্যান্টিসেপটিক লোশন দ্বারা জীবাণুমুক্ত করা হয়, এরপর একটি রাবার ব্যান্ড দ্বারা বাঁধন দেওয়া হয় এবং সিরিঞ্জের সাহায্যে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান এই কাজটি সম্পাদন করেন।
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা: Interpretation of C Reactive Protein Test Results:
সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের পরিমাণ প্রকাশ করা হয় মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (mg/L) হিসাবে। দেহে ইনফেকশন থাকলে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাই দেহে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের পরিমাণ যত কম হয় ততই ভালো।
শরীরে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা 1 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (1 mg/L) এর কম হলে, হার্টের রোগের সম্ভাবনা কম বলেই মনে করা হয়। 1 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (1 mg/L) থেকে 2.9 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (2.9 mg/L)এর মধ্যে হলে, হার্টের রোগের সম্ভাবনা মাঝারি মাত্রায় বলে মনে করা হয়। 3 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (3 mg/L) এর বেশি হলে, হার্টের রোগের সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করা হয়।
দেহে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন মাত্রা 10 মিলিগ্রাম প্রতি লিটার (10 mg/L) এর বেশি হলে, কেন এত বেশি হল সেটা অবশ্যই জানা প্রয়োজন। দেহে তীব্র মাত্রায় ইনফেকশন ঘটলে বা প্রদাহ সৃষ্টি হলে তবেই এত বৃদ্ধি ঘটতে পারে। হারের মধ্যে সংক্রমণ হলে বা অস্টিওপোরোসিস হলে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সমস্যা জনিত কারণে, আর্থ্রাইটিস হলে, ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ হলে, সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়। টিউবারকিউলোসিস অর্থাৎ যক্ষ্মা হলে, লিউপাস নামক রোগে, যোগ কলার রোগে, ক্যান্সার হলে, এমন কি নিউমোনিয়া হলেও দেহে সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা 10 মিলিগ্রাম/লিটারের বেশি হয়।
যে সকল মহিলার জন্মনিয়ন্ত্রণের পিল খাচ্ছেন তাদের সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। গর্ভবতী মায়েদের সি রিয়াকটিভ প্রোটিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বুঝতে হবে যে, দেহে গর্ভধারণ সংক্রান্ত কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। গর্ভবতী মহিলাদের বা যাদের দেহে কোন ইনফেকশন বা প্রদাহ আছে তাদের ক্ষেত্রে হার্টের রোগের সম্ভাবনা জানতে সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করে কোন লাভ হয়না।
মন্তব্য: Remarks:
সি রিয়াকটিভ প্রোটিন টেস্ট করার আগে আপনার ডাক্তার এবং ল্যাবরেটরিতে আপনার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। এটা মনে রাখবেন যে, সি প্রোটিন টেস্ট কোন রোগ সনাক্ত করার নির্দিষ্ট পরীক্ষা নয়। এই পরীক্ষার সাহায্যে দেহে কোন জীবাণুর সংক্রমণ আছে কিনা, কোন প্রদাহ আছে কিনা ইত্যাদি জানা যায়। এছাড়া হার্টের স্বাস্থ্য কেমন আছে সেটা সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। এই টেস্টের সাথে আরও কিছু পরীক্ষা করে তবে রোগ সনাক্ত করা সম্ভব হয়।