কনভালেসেণ্ট প্লাজমা থেরাপি: Convalescent Plasma Therapy:

স্প্যানিশ ফ্লু, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদির হাত থেকে রক্ষা পেতে যে চিকিৎসা পদ্ধতি দারুণ ভাবে সাহায্য করেছিল, সেটা হল প্লাজমা থেরাপি। কোভিড 19 অর্থাৎ করোনা ভাইরাস ঘটিত রোগে, প্রাথমিক পর্যায়ে প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করা হয়েছিল। কোন এবং কিভাবে প্লাজমা থেরাপি কাজ করে, সেটাই হল এই প্রতিবেদনের আলোচনার বিষয়।

প্লাজমা কি? What is Plasma?

আমাদের রক্তের প্রধান উপাদান হল রক্তরস এবং রক্তকণিকা। রক্তের মধ্যে ৫৫ শতাংশ হল রক্তরস। এই রক্তরসকে প্লাজমা বলা হয়। রক্ত থেকে রক্ত কণিকা আলাদা করে নিলে, হালকা হলদে রঙের প্লাজমা পড়ে থাকে। প্লাজমার উপাদান গুলি জল, খনিজ লবণ, বিভিন্ন প্রকার প্রোটিন উৎসেচক, হরমোন ইত্যাদি।

কিভাবে প্লাজমা আমাদের সুস্থ রাখে? How does Plasma keep is healthy?

দেহের পক্ষে ক্ষতিকর কোন জীবাণু আমাদের দেহে প্রবেশ করলে, আমাদের দেহে অবস্থিত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম ওই জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর ফলে জীবাণুকে ধ্বংস হয়। জীবাণুদের ধ্বংস করার জন্য আমাদের দেহে অ্যাণ্টিবডি নামক পদার্থ উৎপন্ন হয়। এই অ্যাণ্টিবডি রক্তরস অর্থাৎ প্লাজমার মধ্যে অবস্থান করে। যে জীবাণুর আক্রমণে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়, কেবলমাত্র সেই জীবাণুকে এই অ্যান্টিবডি ধ্বংস করে। শরীরের অন্য কোন অঙ্গের কোন ক্ষতি করে না।

প্লাজমা থেরাপি কি? What is Plasma Therapy?

যে সকল রোগের তেমন কোন কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি বা ওষুধ নেই, সেইসব ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের প্লাজমা ব্যবহার করে ঐ একই রোগে আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়।

যখন কোন রোগজীবাণু যেমন ইবোলা ভাইরাস, সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস ইত্যাদি আমাদের আক্রমণ করে, তখন আমাদের দেহে ঐ ভাইরাসকে ধ্বংস করার উপযোগী অ্যাণ্টিবডি উৎপন্ন হয়। এই অ্যাণ্টিবডি আমাদের সুস্থ করে তোলে।

রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির রক্তের প্লাজমায় জীবাণু ধ্বংসকারী অ্যাণ্টিবডি থাকে। এই অ্যাণ্টিবডি মিশ্রিত প্লাজমা ঐ নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্তে প্রবেশ করানো হয়। প্লাজমায় উপস্থিত অ্যাণ্টিবডি ওষুধের মত কাজ করে এবং রোগীর দেহে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে রোগীকে সুস্থ করে তোলে।

কেন প্লাজমা থেরাপি করা হয়? Why Plasma Therapy is done?

স্প্যানিশ ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, সিভিআর অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম, মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম এবং কোভিড 19 নামক রোগে, কোন কোন রোগী চিকিৎসায় সারা দেয় না। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, কোন ওষুধ কাজ করে না। এই সকল ক্ষেত্রে প্লাজমা থেরাপি করা হয়। প্লাজমায় থাকা অ্যাণ্টিবডি জীবাণুকে ধ্বংস করে এবং রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্লাজমায় থাকা জীবাণু ধ্বংসকারী অ্যান্টিবডি ওষুধের মত কাজ করে। প্লাজমা থেরাপি গ্রহণ করলে রোগী মাল্টি অর্গান ফেলিওরের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং বেঁচে ওঠে।

যে সকল ব্যক্তিদের হার্টের রোগ আছে, ডায়াবেটিস আছে বা কিডনির রোগ আছে তাদের এবং যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো নেই তাদের, আগে উল্লেখ করা রোগগুলি আক্রমণ করলে খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সকল ব্যক্তিদের প্লাজমা থেরাপি করলে সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

যাদের ফ্যামিলিতে কোন ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হয়েছে, সেই ফ্যামিলির অন্যান্য ব্যক্তিদের প্লাজমা থেরাপি করলে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্য কর্মীদের প্লাজমা থেরাপি করলে জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

নতুন ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সময় প্লাজমা থেরাপির ব্যবস্থা করে রাখা হয়। ওষুধ কাজ করতে ব্যর্থ হলে প্লাজমা থেরাপি করে রোগীকে সুস্থ করে তোলা হয়।

প্লাজমা থেরাপিতে বিপদের সম্ভাবনা কতটা? Risk in Plasma Therapy:

প্লাজমা থেরাপি বহুদিন ধরে প্রচলিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। সাধারণভাবে এই পদ্ধতি বেশ সুরক্ষিত। যে ব্যক্তি রোগ থেকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছে, তার প্লাজমা ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা এই পদ্ধতিকে নিরাপদ বলেই মনে করেন।

এরপরও যা থেকে বিপদ হতে পারে সেগুলি হল:-

অ্যালার্জিক রিয়াকশন হতে পারে।
ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
প্লাজমা গ্রহণের মাধ্যমে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, সি, ইত্যাদির সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কিভাবে প্লাজমা দান করা হয়? How is plasma donated?

প্লাজমা দান করার পদ্ধতিটি সাধারণ রক্তদান অপেক্ষা সামান্য জটিল। হাতের শিরার মধ্যে একটি সূচ বিদ্ধ করে, নলের সাহায্যে একটি বিশেষ যন্ত্রের মধ্যে রক্ত পাঠানো হয়। ওই যন্ত্রটির সাহায্যে রক্ত থেকে প্লাজমা ও প্লেটলেট বা অণুচক্রিকা সংগ্রহ করা হয়। লোহিত রক্তকণিকা গুলিকে স্যালাইন মিশ্রিত করে আবার শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। একবার দান করা প্লাজমা থেকে দুজন রোগীর চিকিৎসা করা যায়।

রোগী কিভাবে প্লাজমা গ্রহণ করে? How does the patient receive the plasma?

প্লাজমা থেরাপি করার আগে রোগীদের এবং রোগীর আত্মীয়দের জানানো হয় ও অনুমতি নেওয়া হয়। এবার শরীরের স্যালাইন প্রবেশ করানোর মতোই প্লাজমা প্রবেশ করানো হয়। একটি প্লাস্টিকের থলির মধ্যে প্লাজমা থাকে। জীবাণুমুক্ত নলের মাধ্যমে সেই প্লাজমা বাহিত হয়ে সূচের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই রোগীর দেহে প্লাজমা প্রবেশ করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বিশেষ নজর দারির মধ্যে সম্পন্ন করা হয়।

প্লাজমা থেরাপির ফলাফল: Result of Plasma Therapy:

প্লাজমা থেরাপি বেশ প্রাচীন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। স্প্যানিস ফ্লু তে এই পদ্ধতি মহামারী নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ইবোলা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্লাজমা থেরাপির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। SARS ও MERS রোগেও প্লাজমা থেরাপি ভালো কাজ করেছে। কোভিড 19 রোগে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ কিছু দেশ মৃত্যুর হার কমিয়ে ফেলেছিল। ভারতও কোভিড 19 এর চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করে ভালো ফল পেয়েছে।

মন্তব্য: Remarks

প্লাজমা থেরাপি নিয়ে গবেষণা এখনো অনেক বাকি। প্লাজমা থেরাপি করা হলে রোগী বাঁচবেই, এটা নিশ্চিত ভাবে কখনোই বলা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই প্লাজমা থেরাপি তেমন কাজ করে না।