রক্ত পরীক্ষা Blood Testসংবাদ News

রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট। Blood for Hemoglobin Test

রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট। Blood for Hemoglobin Test

রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট কেন করা হয় ? Why is the blood hemoglobin test done?

রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার প্রয়োজন হয় যদি আপনার চিকিৎসক মনে করেন যে, আপনার দেহে রক্তের পরিমাণ কম আছে বা দেহে লোহিত রক্ত কণিকার গঠনগত কোন ত্রুটি আছে। লোহিত রক্ত পরিমাণ বেশি আছে মনে হলও রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। দেহে রক্তের পরিমাণ কম থাকলে, যে সকল রোগ লক্ষণ দেখা যায়, সেই সকল রোগ লক্ষণ উপস্থিত থাকলে অবশ্যই রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেতে প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল টেস্ট করা হয় তার মধ্যে হিমোগ্লোবিন টেস্ট উল্লেখযোগ্য। অক্সিজেনের অভাবজনিত কোন রোগের লক্ষণ দেখা গেলেও হিমোগ্লোবিন টেস্ট করা হয়।

হিমোগ্লোবিন কি? What is Hemoglobin?

হিমোগ্লোবিন হল একটি প্রোটিন জাতীয় রঞ্জক পদার্থ। এটি আমাদের রক্তের লোহিত রক্ত কণিকায় উপস্থিত থাকে। লোহিত রক্ত কণিকার মধ্যে হিমোগ্লোবিন উপস্থিত থাকার জন্যই রক্তের রং লাল। কারণ হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জকটির রং হল লাল। হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হল অক্সিজেন পরিবহন করা। অক্সিজেন ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারিনা, আমাদের দেহের কোষগুলিও বাঁচতে পারবেনা। অক্সিজেন ছাড়া আমাদের দেহের কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করতে পারেনা। অক্সিজেনের অভাব হলে বা অক্সিজেন না থাকলে আমাদের ব্রেন এবং হৃৎপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ অক্সিজেন হলও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্যাস এবং এই গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসটিকে পরিবহন করে হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হলে বা বেশি হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে।

কখন হিমোগ্লোবিন টেস্ট করা হয়? When is the hemoglobin test done?

আমাদের শরীর কতটা অক্সিজেন পাচ্ছে তার একটি সূচক হল হিমোগ্লোবিন। আমাদের রক্তে পর্যাপ্ত আয়রন আছে কিনা সেটা বোঝা যায় এই টেস্টের সাহায্যে। তদনুসারে, আপনার ডাক্তার হিমোগ্লোবিন পরিমাপের জন্য কমপ্লিট ব্লাড কাউণ্টের সাথে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার কথা বলতে পারেন। দেহে অক্সিজেন অভাব বা আয়রনের অভাবজনিত কোন লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা গেলে এই পরীক্ষা করতে হয়।

হিমোগ্লোবিন কম থাকলে যেসকল রোগ লক্ষণ দেখা যায় সেগুলি হল,

ক্লান্তি,
স্বাভাবিক কাজকর্ম করার সময় শ্বাসকষ্ট,
মাথা ঘোরা,
চামড়া স্বাভাবিকের চেয়ে বা হলুদে হয়ে যাওয়া,
মাথাব্যথা,
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন,

হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বেশি থাকলেও সমস্যা। দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হলে যেসকল লক্ষণ দেখা যায়, সেগুলি হল-

দৃষ্টির সমস্যা,
মাথা ঘোরা,
মাথাব্যথা,
কথা বলতে কষ্ট হওয়া,
মুখ দিয়ে লাল ঝরা ইত্যাদি।
এই সব ক্ষেত্রেও রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করা উচিত।

রক্তের কিছু রোগ, যেমন সিকেল সেল অ্যানিমিয়া বা থ্যালাসেমিয়া,ফুসফুস, লিভার, কিডনি বা কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে প্রভাবিত করে এমন রোগে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার দরকার হয়। আঘাত লেগে বা অস্ত্রোপচার থেকে উল্লেখযোগ্য রক্তপাত হয়ে থাকলে, অপুষ্টি বা ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাবজনিত কোন রোগ হলে এই টেস্ট করতে দেওয়া হয়। দেহে দীর্ঘমেয়াদী উল্লেখযোগ্য কোন সংক্রমণ হলে, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে চিন্তাভাবনার সমস্যা হলে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করতে দেওয়া হয়। কিছু বিশেষ ধরণের ক্যান্সারে CBC টেস্টের সাথে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করতে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যে সম্পর্কে প্রাথমিক মূল্যায়ন করার জন্য যেসকল টেস্ট করতে দেওয়া হয়, তার মধ্যে হিমোগ্লোবিন টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ।

কিভাবে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করা হয়? How is hemoglobin tested?

হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন রকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে। একজন সাধারণ রোগীরও এই ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ বেশ কিছু ল্যাবরেটরি প্রাচীন পদ্ধতিতে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করেন, যা বর্তমানে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। পুরাতন পদ্ধতিতে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করলে সঠিক ফলাফল পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই হিমোগ্লোবিনের সর্বাপেক্ষা আধুনিক পদ্ধতি সায়ানমেথেমোগ্লোবিন পদ্ধতি (cyanmethemoglobin method) ব্যবহার করে বর্তমানে হিমোগ্লোবিন টেস্ট করা হয়।

হিমোগ্লোবিন টেস্ট এর জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ। Collection of blood sample for hemoglobin test.

হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার জন্য বিশেষ কোনও নিয়ম মানার প্রয়োজন হয় না। যদিও প্যাথলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন এর ক্ষেত্রে রক্ত নমুনা দেওয়ার আগে বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। সৌভাগ্যক্রমে হিমোগ্লোবিন টেস্টের জন্য অনাহারে থাকার কোন প্রয়োজন হয় না। খাদ্য গ্রহণ করে বা খালি পেটে রক্তের নমুনা দেওয়া যায়। যেকোনো সময় রক্তের নমুনা দেয়া যেতে পারে। তবে সকালে রক্ত দেওয়া ভালো। রক্ত নমুনা সংগ্রহ করার জন্য সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত নেওয়া হয়।

আঙুলে সূচ-বিদ্ধ করেও রক্তে নমুনা দেওয়া যেতে পারে। রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য সুচ-বিদ্ধ করার স্থানটিতে অ্যালকোহল ব্যবহার করে জীবাণু মুক্ত করা হয় এবং তারপর সূচ বিদ্ধ করে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। হিমোগ্লোবিন টেস্ট করার জন্য সম্পূর্ণ রক্ত (Whole Blood) ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রক্তকণিকা এবং প্লাজমা Plasma আলাদা করা হয় না। একারণে রক্ত সংগ্রহ করার পাত্রে বিশেষ ধরনের অ্যান্টিকুয়াগুলেন্ট অর্থাৎ রক্ত জমাট বাঁধতে বাধাদানকারী পদার্থ ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে, তার জন্য প্রয়োজনে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।

হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা বা নরমাল রেঞ্জ। Normal range of hemoglobin.

পুরুষদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা হল 14 থেকে 17 / ডেসিলিটার।
মহিলাদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের স্বাভাবিক মাত্রা হল 13 থেকে 15 গ্রাম / ডেসলিটার

হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা। Interpretation of hemoglobin test results.

হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি হতে পারে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। বিশেষ করে যারা স্মোকার অর্থাৎ ধূমপান করেন, তাদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বেশি হয়। অর্থাৎ হিমোগ্লোবিন বেশি মানেই ভালো সেটা বলা যাবে না। এছাড়া যারা পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন, পাহাড়ের ট্রি লাইনের উপরে বসবাস করেন, যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ একটু কম থাকে। সেখানে রক্তে অক্সিজেন পরিবহন সহজ করার জন্য হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বেশি হয়। অর্থাৎ পাহাড়ি মানুষদের স্বাভাবিকভাবেই হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ একটু বেশি হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেশি হতে পারে।

হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হতে পারে বিভিন্ন কারণে। কোন কারণে দেহে রক্তের অভাব হলে, দেহের কোন অঙ্গ থেকে রক্তক্ষরণ হলে, পৌষ্টিক তন্ত্রের মধ্যে কোথাও ক্ষতের সৃষ্টি হলে অর্থাৎ আলসার সৃষ্টি হলে, দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হতে পারে। শরীরের কোন অঙ্গের ভিতরে গভীরে কোথাও রক্তক্ষরণ হলেও হিমোগ্লোবিনি পরিমাণ কম হতে পারে। এছাড়া পুষ্টির অভাবে, ভিটামিনের অভাবে, বেশ কিছু খনিজ উপাদানের অভাবে, হিমোগ্লোবিন কম কম হয় হয়।

অ্যাক্সিডেণ্টের ফলে রক্তক্ষরণ হলে, অত্যধিক রক্তপাত হলে, শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে গেলে, ভীষণভাবে হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে কোন সমস্যা থাকলে বা ঘাটতি হলে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হতে পারে। হিমোগ্লোবিনের মধ্যে গঠনগত ত্রুটি হলেও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে মেনস্টাল পিরিয়ডের সময় অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে হিমোগ্লোবিন কম হতে পারে। এছাড়া মহিলাদের মধ্যে আয়রনের অভাব ঘটার কারণেও হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হয়। সন্তান ধারণ করার সময় এবং সন্তানের জন্ম দেয়ার সময় মহিলাদের দেহে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হয়।