হাই ব্লাড প্রেশার কমানোর ঘরোয়া উপায়: Home remedies for high blood pressure:
হাই ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে, হার্টের রোগ ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। ওষুধের পাশাপাশি কিছু প্রাকৃতিক প্রতিকার আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে। হাই ব্লাড প্রেশার কমানোর ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জানতে সঙ্গে থাকুন।
উচ্চ রক্তচাপ কি? What is High Blood Pressure?
আমাদের হৃৎপিণ্ড রক্তনালীর মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত পরিবহন করে। রক্তচাপ হল সেই বল, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়। রক্তচাপ বেশি থাকলে রক্তনালী দিয়ে রক্ত জোরে জোরে চলাচল করে। এরফলে রক্তনালীর ক্ষতি হতে পারে। বিভিন্ন কারণে রক্তের চাপ বেশি হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম, কম ঘুম, অতিরিক্ত ব্যায়াম ইত্যাদি কারণে রক্তচাপ বেশি হতে পারে। বিশ্রাম নিলে এবং ঘুম ভাল হলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এইরকম পরিবর্তন একদম স্বাভাবিক। সাধারণত কম বয়সে রক্তচাপ কম থাকে। যদি কোন ব্যক্তির রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং বেশিরভাগ সময় এমনকি বিশ্রামরত অবস্থায়ও বেশি থাকে, সেক্ষেত্রে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বলা যেতে পারে। রক্তচাপ দুই প্রকার; সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক।
রক্তচাপের বিভিন্ন মাত্রা:
বিভাগ | সিস্টোলিক (মিলিমিলার মার্কারি) | ডায়াস্টোলিক (মিলিমিলার মার্কারি) |
---|---|---|
স্বাভাবিক রক্তচাপ | 120 | 80 |
প্রি হাইপারটেনশন | 120 – 139 | 80 – 89 |
হাইপারটেনশন স্টেজ 1 | 140 – 159 | 90 – 99 |
হাইপারটেনশন স্টেজ 2 | 160 বা তার বেশি | 100 বা তার বেশি |
আমাদের দেহে সিস্টোলিক রক্তচাপ 120 মিলিমিটার মার্কারি ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ 80 মিলিমিটার মার্কারি থাকলে রক্তচাপ স্বাভাবিক আছে বলা হয়।
সিস্টোলিক রক্তচাপের পরিমাণ 120 থেকে 149 মিলিমিটার মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ 80 থেকে 89 মিলিমিটার মার্কারির মধ্যে থাকলে প্রি হাইপারটেনশন অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা শুরু হতে চলেছে বলা যেতে পারে।
দেহে সিস্টোলিক রক্তচাপ 140 থেকে 159 মিলিমিটার মার্কারি এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ 90 থেকে 99 মিলিমিটার মার্কারির মধ্যে থাকলে উচ্চ রক্তচাপ হাইপারটেনশন স্টেজ – 1 দশা শুরু হয়েছে।
সিস্টোলিক রক্তচাপ 180 বা তার বেশি হলে এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ 100 মিলিমিটার মার্কারি বা তার বেশি হলে, উচ্চ রক্তচাপ হাইপারটেনশন স্টেজ – 2 অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ: Symptoms of High Blood Pressure:
বেশিরভাগ ব্যক্তিদের উচ্চ রক্তচাপের তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না। এমনকি বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছালেও রোগ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। কোন লক্ষণ ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে উচ্চ রক্তচাপ থাকতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ হলে মাথা ব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, বমি বমি ভাব, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ইত্যাদি রোগ লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ঘরোয়া উপায়: Home Remedies for High Blood Pressure:
উচ্চ রক্তচাপ কমানো বেশ কিছু ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হল। এই প্রতিকারগুলি সত্যিই ভাল কাজ করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ: Maintain a moderate weight:
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা উচ্চ রক্তচাপ ও সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, মাত্র 5% ওজন কমলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়। দেহের ওজন মাঝারি রাখলে রক্তনালীগুলির সংকোচন প্রসারণ স্বাভাবিক থাকে। এছাড়া কোমরের চারপাশে অতিরিক্ত চর্বি থাকলে, হার্টের রোগ ও উচ্চ রক্তচাপ সহ দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর স্বাস্থ্য সংকট হতে পারে। ওজন ও রক্তচাপ একসাথে চলে, তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
কম লবণ গ্রহণ: Limit Salt:
লবণের মধ্যে থাকে সোডিয়াম। আমরা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ গ্রহণ করে থাকি। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, সোডিয়াম বেশি গ্রহণ করলে রক্তচাপ বাড়ে এবং স্ট্রোক ও হার্টের রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। বেশি লবণ গ্রহণ করলে দেহে তরলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। যাদের রক্তচাপ বেশি থাকে, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই লবণ গ্রহণের পরিমাণ কম করা দরকার। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে, তাই প্রক্রিয়াজাত খাদ্য কম গ্রহণ করতে হবে।
নিয়মিত হাটা ও ব্যায়াম: Regular Walk and Excercise:
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য সেরা উপায় হল হাঁটা ও ব্যায়াম। নিয়মিত ব্যায়াম আমাদের হৃৎপিণ্ডকে শক্তিশালী ও রক্ত পাম্প করার উপযোগী করে তোলে। ফলে ধমনীতে চাপ কমে। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, সপ্তাহে 150 মিনিট মাঝারি মাত্রার ব্যায়াম করলে, যেমন হাঁটলে, রক্তচাপ কমে। সপ্তাহে 75 মিনিট জোরালো ব্যায়াম করলে, যেমন দৌড়লে, রক্তচাপ কমে ও হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। নিয়মিত শারীরিক কসরত করলে, রক্তচাপ প্রায় 5 থেকে 8 মিলিমিটার মার্কারি পর্যন্ত কমাতে পারে। রক্তচাপ বাড়তে না দেওয়ার জন্যও ব্যায়াম চালিয়ে যেতে হবে। হাঁটা ও দৌড়ানো ছাড়াও জগিং, সাইকেল চালানো, সাঁতার, নাচ, ইত্যাদিতেও ভাল কাজ হয়।
স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: Healthy Diet:
উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। শস্য, ফল, শাকসবজি, কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য এবং কম কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খেলে, উচ্চ রক্তচাপ 11 মিলিমিটার মার্কারি পর্যন্ত কমতে পারে। এছাড়া কম চর্বিযুক্ত মাংস, মাছ এবং বাদাম খেলেও বেশ উপকার হয়। যে খাবারগুলি একেবারেই খাওয়া উচিত নয় সেগুলি হল, উচ্চ চর্বিযুক্ত মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, মিষ্টি পানীয় সোডা, জুস, ইত্যাদি।
মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ: Limit Alcohol:
অতিরিক্ত মদ্যপান একেবারেই চলবে না। মদ্যপান না করলে বা কম করলে রক্তচাপের সমস্যা কমে। মদ্যপান করলে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, ফলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে রাতের খাবারের সাথে অল্প পরিমাণ রেড ওয়াইন খাওয়া, হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ধূমপান ত্যাগ: Quit Smoking:
ধূমপান রক্তচাপ বাড়ায়। অবশ্যই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। যে মুহূর্তে ধূমপান করা হয়, সেই মুহূর্তে অস্থায়ীভাবে রক্তচাপ বেড়ে যায়। নিয়মিত ধূমপান করলে রক্তচাপ দীর্ঘ সময়ের জন্য বাড়তে পারে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা ধূমপান করলে বিপদ হতে পারে। এক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়। ধূমপান ত্যাগ করলে সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: Reduce Stress:
মানসিক চাপ সাময়িকভাবে আমাদের রক্তচাপ বাড়াতে পারে। অত্যধিক মানসিক চাপ আমাদের বিপদে ফেলতে পারে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিয়মিত বিশ্রাম নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। মানসিক চাপের কারণ অনুসন্ধান করে তার সমাধান করতে হবে। যোগ ব্যায়াম, প্রাণায়াম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ধ্যান ইত্যাদি মানসিক চাপ কমাতে খুবই উপযোগী। এছাড়া খেলাধুলা, গানবাজনা, ধর্মচর্চা ইত্যাদিও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখে।
প্রাকৃতিক সম্পূরক গ্রহণ: Taking Natural Suppliment:
কিছু প্রাকৃতিক সম্পূরক রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রচলিত চিকিৎসার সাথে রসুনের নির্যাস ব্যবহার করলে রক্তচাপ কমে। দুগ্ধজাত হোয়ে প্রোটিন গ্রহণ করলে রক্তচাপ কমে এবং রক্তনালীর কার্যকারিতা উন্নত হয়। মাছের তেল গ্রহণ করা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল। মাছের তেল উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের যথেষ্ট উপকার করে। জবা ফুলের মধ্যে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন ও পলিফেনাল যা হার্টের স্বাস্থ্য ভাল রাখে এবং রক্তচাপ কমায়। জবা ফুল দিয়ে সুস্বাদু চা তৈরি করে সেবন করা যেতে পারে।
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ: Blood Pressure Monitoring:
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করলে বড় ধরনের সমস্যা হওয়ার আগে সচেতন হওয়া যায়। সমস্যা শুরু হওয়ার আগে জীবন যাত্রার পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। বাড়িতে রক্তচাপ পরিমাপ করার জন্য একটি ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার মনিটর কিনে নিয়ে খুব সহজেই রক্তচাপ পরিমাপ করা যায়। প্রয়োজনে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে কথা বলা যেতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ একটি গুরুতর সমস্যা। উচ্চ রক্তচাপ থেকে হার্ড ও রক্তনালীর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা ধরা পড়লে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং চিকিৎসা শুরু করতে হবে।