পাইলস কেন হয়? পাইলস থেকে মুক্তির উপায় কী? What causes piles? Piles treatment with surgery:
পাইলস কেন হয়? পাইলস থেকে মুক্তির উপায় কী? What causes piles? Piles treatment with surgery:
মলদ্বারর ও মলদ্বারের দেয়ালের রক্তনালী ফুলে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়াকে পাইলস বা হেমোরয়েডস (Hemorrhoids) বলা হয়। মলদ্বারের প্রধান তিনটি রোগ হল; ফিসার, ফিসচুলা ও পাইলস। এই প্রতিবেদনে পাইলসের কারণ, রোগ লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
পাইলস বা হেমোরয়েড কী? What are Piles or Hemorrhoids?
পাইলস বা হেমোরয়েড হল মলদ্বারের শিরা ফুলে গিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হওয়া। এগুলি মলদ্বারের ভিতরের দিকে বা বাইরের দিকে হতে পারে। যে কোন বয়সের ব্যক্তিদের পাইলস হতে পারে। পাইলস হল গোলাকার, ছোট বিবর্ণ পিণ্ডের মত; যা মলদ্বারের মধ্যে অনুভব করা যায় বা মলদ্বারের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এগুলি যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, অস্বস্তিকর হতে পারে এবং এর ফলে মলদ্বার থেকে রক্তপাত হতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার পাইলস ও তার লক্ষণ: Types of Piles (Hemorrhoids) & Their Symptoms:
পাইলস প্রধানত তিন প্রকার। বিভিন্ন প্রকার পাইলস নিয়ে আলোচনা করা হল:
বাহ্যিক হেমোরয়েডস: External Hemorrhoids:
এই ধরনের পাইলস, মলদ্বারের চারপাশে ত্বকের নিচে পাওয়া যায়। বাহ্যিক হেমোরয়েডের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি হল;
মলদ্বার অঞ্চলে চুলকানি ও জালা হওয়া, তীব্র ব্যথা বা অস্বস্তি, পায়ু দ্বার ফুলে যাওয়া ও মলদ্বারে রক্তপাত হওয়া ইত্যাদি।
অভ্যন্তরীণ হেমোরয়েডস: Internal Hemorrhoids:
মলদ্বারের ভিতরের দিকে অভ্যন্তরীণ পাইলস দেখতে পাওয়া যায়। রোগী সাধারণত এই ধরনের পাইলস অনুভব করতে পারে না। এগুলি বাহ্যিক পাইলসের মত অস্বস্তিকর নয়, কিন্তু মলত্যাগ করার সময় কিছু সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে মলত্যাগের সময় রক্তপাত হয়। তবে সাধারণত এই ধরনের পাইলস থেকে ব্যথা হয় না।
থ্রমবোজড হেমোরয়েডস: Thrombosed Hemorrhoids:
এই ধরনের হেমোরয়েডসের ক্ষেত্রে, একটি বাহ্যিক হেমোরয়েডের মধ্যে রক্ত জমা হয় এবং সেই রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলে চরম যন্ত্রণা হয়, পায়ু অঞ্চল ফুলে যায় ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এছাড়া মলদ্বারের চারপাশে শক্ত পিণ্ড তৈরি হয়।
পাইলসের বিভিন্ন পর্যায়ে: Different Grades of Piles:
গ্রেড 1
এই পর্যায়ে, রোগীর তেমন কোন রোগ লক্ষণ দেখা যায় না এবং পাইলস মলদ্বার থেকে বাইরে বের হয় না।
গ্রেড 2
এই পর্যায়ে, হেমোরয়েড, মলদ্বার থেকে বাইরে বের হতে পারে। কিন্তু নিজে নিজেই আবার ভিতরে চলে যায়।
গ্রেড 3
এই পর্যায়ে, পাইলস মলদ্বারের বাইরে বৃদ্ধি পায় এবং হাত দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে ভিতরে পাঠাতে হয়।
গ্রেড 4
এই পর্যায়ে, হেমোরয়েড মলদ্বারের বাইরে বৃদ্ধি পায় এবং কোনভাবেই ভিতরে প্রবেশ করানো সম্ভব হয় না।
পাইলসের কারণ কী? What Cause Hemorroids?
বিভিন্ন কারণে পাইলসের সমস্যা হতে পারে। যে সকল কারণে হেমোরয়েডসের সমস্যা হয় সেগুলি হল;
কোষ্ঠকাঠিন্য: Constipation:
মল শক্ত হলে, মলত্যাগ করার সময় চাপ প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে মলদ্বারের শিরায় অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং পাইলসের বিকাশ ঘটে।
ডায়রিয়া: Diarrhea:
ডায়রিয়া হলে ঘন ঘন মলত্যাগ করতে হয়। এর ফলে মলদ্বারে জ্বালা ও প্রদাহ সৃষ্টি হয়ে হেমোরয়েডস হতে পারে।
গর্ভাবস্থা: Pregnancy:
গর্ভাবস্থায় দেহে হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি ঘটে এবং মলদ্বারের শিরা গুলির উপর চাপ পড়ে। ফলে পাইলসের সৃষ্টি হতে পারে।
বার্ধক্য: Aging:
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মলদ্বারের পেশীগুলি ও শিরাগুলি দুর্বল হয়ে যায়, ফলে পাইলসের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
পায়ু সঙ্গম: Anal Intercourse:
পায়ুপথে সঙ্গমের কারণে মলদ্বারের শিরাগুলির তে চাপ সৃষ্টি হয়ে পাইলস হতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী কাশি: Chronic Cough:
দীর্ঘদিন ধরে কাশির সমস্যা হলে মলদ্বারে ও মলদ্বারের শিরাতে চাপ পড়ে। ফলে পাইলসের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
বাধাগ্রস্ত মলত্যাগ: Obstructive Defecation:
মলত্যাগ করার জন্য প্রয়োজনীয় পেশীগুলি সঠিকভাবে কাজ না করলে, মলত্যাগ করতে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে পাইলসের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
পাইলস রোগনির্ণয় ও পরীক্ষা: Piles – Diagnosis & Test:
পাইলস রোগ নির্ণয় করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল।
শারীরিক পরীক্ষা: Physical Examination:
পাইলস শনাক্ত করার জন্য আপনার চিকিৎসক মলদ্বার পরীক্ষা করে দেখবেন এবং কোন শিরা ফুলে গিয়ে হেমোরয়েডস সৃষ্টি করেছে কিনা, সেটা দেখবেন। মলদ্বারের মধ্যে আঙুল প্রবেশ করিয়ে মলদ্বারে কোন অস্বাভাবিকতা আছে কিনা দেখা হয়।
অ্যানোস্কোপি: Anoscopy:
এই পদ্ধতিতে অ্যানোস্কোপ নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে মলদ্বার পরীক্ষা করে দেখা হয়। অ্যানোস্কোপি করে হেমোরয়েডসের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
কোলোনোস্কোপি: Colonoscopy:
এই পদ্ধতিতে মলদ্বার ও কোলনের ভিতরের অংশ পরীক্ষা করে দেখা হয়। কোন স্থানে রক্তপাত হলে বা পাইলস হলে সৃষ্টি হলে, সেটা সঠিকভাবে শনাক্ত করা হয়।
রক্ত পরীক্ষা: Blood Test:
পাইলস রোগ সনাক্ত হওয়ার পর রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা পেতে বেশ কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্তের হিমোগ্লোবিন টেস্ট, কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট টেস্ট, ব্লিডিং টাইম, ক্লটিং টাইম, লিভার ফাংশন টেস্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। অনেক সময় বেরিয়াম এক্স রে করার প্রয়োজন হয়।
পাইলসের চিকিৎসা: Pilse Treatment:
সৌভাগ্যক্রমে পাইলসের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে। সঠিকভাবে চিকিৎসা করালে পাইলস রোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য।
পাইলসের ঘরোয়া প্রতিকার: Home Remedies of Piles:
পাইলসের ব্যথা ও ফলাফল কমানোর জন্য বেশ কিছু ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করলে বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়।
উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে মল নরম থাকে ও পাইলসের সমস্যা কমে। পাইলসের রোগীদের ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য ইত্যাদি ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
মলদ্বারে পাইলস ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। এই সকল ক্রিম কেনার জন্য প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয় না। মলদ্বারের জ্বালা ও ফোলা কমানোর জন্য জিংক অক্সাইড যুক্ত ক্রিম ব্যবহার করা হয়। এটি পায়ু দ্বারের চুলকানি দূর করতে বেশ কার্যকরী। স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম ব্যবহার করলে হেমোরয়েডসের প্রদাহ কমে। কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম খুব জনপ্রিয়। এছাড়া চেতনা নাশক ক্রিম, ব্যথা ও চুলকানি কমাতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
মলদ্বারে হালকা গরম জলের সেক নিলে বেশ আরাম লাগে। তবে জল যেন বেশি গরম না হয়। একটি গামলাতে কয়েক লিটার গরম জল দিয়ে 10 থেকে 15 মিনিট বসতে হবে। দিনে দুই থেকে তিনবার এই সেক নিতে হবে।
পাইলসের ব্যথা কমানোর জন্য প্রয়োজনে অ্যাসিটামিনোফেন (Acetaminophen), আইবুপ্রোফেন (Ibuprofen) ইত্যাদি ব্যথার ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
অস্ত্রোপচার বিহীন চিকিৎসা: Non – Surgical Treatment of Piles:
ঘরোয়া চিকিৎসা ও সাধারণ ক্রিমগুলি ব্যবহার করার পরও হেমোরয়েডসের উপশম নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশেষ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করে পাইলসের সমস্যার সমাধান করা যায়।
হেমোরয়েডের মধ্যে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করার জন্য হেমোরয়েডের গোরায় একটি রাবার ব্যাণ্ড পরিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে হেমোরয়েড সংকুচিত হয় ও সম্পূর্ণভাবে খসে পড়ে।
স্কেলেরোথেরাপি (Sclerotherapy) করে হেমোরয়েড দূর করা যায়। এক্ষেত্রে হেমোরয়েডের মধ্যে একটি বিশেষ তরল ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। এর ফলে হেমোরয়েডের মধ্যে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় ও পাইলস সেরে যায়।
ইলেক্ট্রোকোয়াগুলেশন (Electrocoagulation) পদ্ধতিতে হেমোরয়েডের মধ্যে কম মাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়। এটি রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে হেমোরয়েড গুলিকে সংকুচিত করে তোলে।
ইনফ্রারেড আলোর সাহায্যে অভ্যন্তরীণ হেমোরয়েডের চিকিৎসা করা হয়। এক্ষেত্রে আলোর সাহায্যে হেমোরয়েড গুলিকে গরম করে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করা হয় ও পাইলসটি সংকুচিত হয়।
অস্ত্রোপচারের সাহায্যে পাইলসের চিকিৎসা: Surgical Treatment of piles:
অস্ত্রোপচার হল পাইলসের সবচেয়ে সেরা ও নিশ্চিত পদ্ধতি। যন্ত্রণা, ব্যথা, অস্বস্তি, শ্লেষ্মা স্রাবের সমস্যা থাকলে, অস্ত্রোপচারের সাহায্যে চিকিৎসা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ, সে কোন ধরনের পাইলস অস্ত্রোপচারের সাহায্যে অপসারণ করা হয়।
লেজার সার্জারি করলে খুব কম কাটা ছেঁড়া করে আশ্চর্যজনক ভালো ফল পাওয়া যায়। লেজার সার্জারিতে একটি উচ্চশক্তির আলো ব্যবহার করে অপারেশন করা হয়। এই পদ্ধতি অত্যন্ত নিরাপদ, রক্তপাতহীন এবং কম বেদনাদায়ক।