ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ | Common Signs of Vitamin Deficiency
দেহে ভিটামিনের অভাব হচ্ছে বুঝবেন কিভাবে? Sign Youare not getting enough Vitamins.
সুষম ও পুষ্টিকর খাবার আমাদের জন্য খুবই উপকারী। আবার পুষ্টির অভাব আছে এমন খাদ্য আমাদের দেহে ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টি করতে পারে। দেহে ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব হলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিবেদনে ভিটামিনের অভাবজনিত লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ভঙ্গুর চুল ও নখ: Brittle hair and nails:
চুল ও নখ ভঙ্গুর হওয়ার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল বায়োটিন নামক ভিটামিনের অভাব। বায়োটিন ভিটামিন B7 নামে পরিচিত। এই ভিটামিন দেহে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। সাধারণত দেহে বায়োটিনের অভাব ঘটে না। কিন্তু কোন কারণে বায়োটিনের অভাব ঘটলে চুল ও নখ পাতলা হয়ে যায় এবং সহজে ভেঙে যায়। এছাড়া দেহে বায়োটিনের অভাব হলে পেশীতে ব্যথা, ক্রাম্প, হাত ও পায়ে ঝাঁকুনি, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।
গর্ভবতী মহিলা, অত্যধিক ধূমপায়ী, মদ্যপানকারী এবং ক্রোনস ডিজিজের রোগীদের দেহে বায়োটিনের অভাব হতে পারে। কিছু ওষুধ যেমন অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টি-সিজার ইত্যাদি ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করলে, দেহে বায়োটিনের অভাব হতে পারে। কাঁচা ডিমের সাদা অংশ খেলে, দেহে বায়োটিনের অভাব হতে পারে। কারণ কাচা ডিমের সাদা অংশে অ্যাভিডিন নামক অ্যান্টি ভিটামিন থাকে। এই অ্যাভিডিন বায়োটিন শোষণে বাধা দেয়।
বায়োটিনের অভাব মেটাতে, বায়োটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। বায়োটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গুলি হল; মাছ, মাংস, ডিম, দুগ্ধজাত খাদ্য, বাদাম, পালং শাক, ব্রকলি, ফুলকপি, আলু, দানাশস্য, কলা ইত্যাদি। এছাড়া বায়োটিন যুক্ত সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করলে বায়োটিনের অভাব মেটে।
অত্যধিক চুল পড়া: Severe hair loss:
প্রতিদিন 100টির বেশি চুল পড়লে অবশ্যই এটা নিয়ে চিন্তার বিষয়। বিভিন্ন কারণে চুল পড়তে পারে। থাইরয়েড রোগে চুল পড়ে, তবে চুল পড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল দেহে আয়রনের অভাব। দেহে আয়রনের অভাব হলে মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, সব সময় ঠাণ্ডা অনুভব করা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। চুলের স্বাস্থ্য রক্ষায় নিয়াসিন ও বায়োটিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া জিংকের অভাবেও চুল পড়তে পারে।
আমরা খুব সহজেই আয়রনের অভাব দূর করতে পারি। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করলে, তিন চার মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়। মাছ, মাংস, ডিম, লেবু, সবুজ শাকসবজি, বাদাম ইত্যাদি গ্রহণ করলে আয়রন, জিঙ্ক,নিয়াসিন ও বায়োটিনের অভাব মেটে। বেশ কিছু পরিপূরক খাদ্য, চুল পড়া রোধ করতে পারে। আসলে এই সকল পরিপূরক খাদ্যের মধ্যে প্রয়োজনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে। তবে পরিপূরক খাদ্য গ্রহণ করলে চুল পড়া বন্ধ হয় কিনা, সেটা সম্পর্কে খুব কম গবেষণা আছে।
মুখে ঘা বা মুখের কোনে ফাটল: Mouth ulcer or cracks in the corners of the mouth:
খনিজ উপাদান বা ভিটামিনের অভাবে, মুখের মধ্যে এবং মুখের চারপাশে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। যেমন আয়রন বা ভিটামিন বি এর অভাবে মুখের ঘা অর্থাৎ ক্যানকার ঘা হতে পারে। গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, মুখের ঘা যুক্ত রোগীদের দেহে আয়রনের অভাব থাকতে পারে ও ভিটামিন B এর অভাব থাকে। মুখের কোণে ফাটল দেখা যায় বা রক্তপাত ঘটে, মুখে অতিরিক্ত লালা নিঃসরণের কারণে বা দেহে জলের অভাব হলে এই ধরণের সমস্যা দেখা যায়। তবে দেহে আয়রন বা ভিটামিন B এর অভাবেও মুখের কোন ফাটে।
দেহে আয়রন ও ভিটামিন B এর অভাব দূর করতে, গোটা শস্য, সবুজ শাকসবজি, বাদাম, ডাল শস্য, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে।
পা ও জিভে জ্বালাপোড়া: Burning sensation in feet and tongue:
পা জ্বালাপোড়া করলে বা জিভ জ্বালাপোড়া করলে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। সম্ভবত এই সমস্যা ভিটামিন B এর অভাবের কারণে হচ্ছে। এর সাথে চিন্তা ভাবনা করতে সমস্যা হলে, কোষ্ঠকাঠিন্য ও শুষ্ক ত্বকের সমস্যা থাকলে রক্তের ভিটামিন B 12 পরীক্ষা করা প্রয়োজন। রক্তের প্রধান উপাদান হিমোগ্লোবিন। এই হিমোগ্লোবিন উৎপাদন করতে ভিটামিন B 12 খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হিমোগ্লোবিন দেহে অক্সিজেন পরিবহন করে এবং আমাদের সুস্থ সবল রাখে। ভিটামিন B 12 এর অভাব হলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয় এবং ভাবনা চিন্তায় সমস্যা হয়। হাত ও পায়ের নার্ভের ক্ষতি হওয়ার কারণে, হাত পা জ্বালাপোড়া করে।
নিরামিষাশী ব্যক্তিদের দেহে ভিটামিন B 12 এর অভাব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ভিটামিন B 12 এর অভাব দূর করতে প্রধানত প্রাণীজ খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুগ্ধজাত খাদ্য ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ভুট্টা, ঢেঁকি ছাটা চাল, মাশরুম, সয়াবিন, নারকেল ইত্যাদির মধ্যেও ভিটামিন B 12 পাওয়া যায়।
ক্ষত নিরাময়ে দেরি: Wounds are slow to heal:
প্রতিদিন ব্রাশ করার সময় মারি লাল হয়ে গেলে ও মাড়ি থেকে রক্তপাত হলে ভিটামিন C গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ ভিটামিন C এর অভাবে এই সমস্যা হয়। ভিটামিন C আমাদের ত্বকের কোশগুলিকে একত্রিত করে এবং ক্ষত নিরাময় করে। ভিটামিন C সিমেন্টের মতো কাজ করে এবং ক্ষত সারিয়ে তোলে।
ভিটামিন C অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবেও কাজ করে। ভিটামিন C এর পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হলে ধূমপান বন্ধ করতে হবে। কারণ ধূমপান ভিটামিন C শোষণ বাধা দেয়। এছাড়া ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন টমেটো, পেয়ারা, আমলকী, কমলালেবু, ক্যাপসিকাম, লংকা, স্ট্রবেরি, পেঁপে, আম, কলা ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। গরম করলে ভিটামিন C নষ্ট হয়ে যায়; তাই ফল ও শাকসবজি কাঁচা গ্রহণ করতে হবে।
হাড়ে ব্যথা: Bone pain:
হাড়ে ব্যথা হলে এবং ব্যথা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে, অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এটা ভিটামিন D এর অভাব থেকে হতে পারে। হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে ভিটামিন D খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভিটামিন D এর অভাব পূরণ করার জন্য, ভিটামিন D যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ভিটামিন D সমৃদ্ধ খাদ্য গুলি হল; সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, মাশরুম, দুধ, কমলালেবু, সয়াবিন ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিদিন সূর্যালোকে কম করে 30 মিনিট সময় কাটালে ভিটামিন ডি এর অভাব মেটে। আমাদের ত্বক সূর্যালোকের সাহায্যে ভিটামিন D উৎপাদন করতে পারে। গুরুতর ঘাটতির ক্ষেত্রে ভিটামিন D সম্পূরক গ্রহণ করতে হবে।
অনিয়মিত হৃদস্পন্দন:Irregular heartbeat:
ক্যালসিয়াম আমাদের হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেহে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে অ্যারিদমিয়া অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। এমনকি বুকে ব্যথাও হতে পারে। ক্যালসিয়ামের অভাব হলে দেহে আরও কিছু রোগ লক্ষণ দেখা যায়। যেমন মাসলের সংকোচন প্রসারণে সমস্যা হতে পারে। পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ছাড়া পেশি পুরোপুরি শিথিল হয় না। এছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় দুর্বল হয়ে যায়, হাড় ক্ষয়ে যায় ও সহজে ভেঙে যেতে পারে।
ক্যালসিয়ামের অভাব দূর করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন D যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য গুলি হল; সামুদ্রিক মাছ, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ব্রকলি ইত্যাদি।
রাত্রে দুর্বল দৃষ্টি: Poor night vision:
খাদ্যে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ উপস্থিত না থাকলে কখনও কখনও দৃষ্টির সমস্যা হতে পারে। দেহে ভিটামিন A এর অভাব হলে রাতকানা রোগ হতে পারে। ভিটামিন A রোডপসিন নামক রঞ্জক তৈরিতে সাহায্য করে। চোখের রেটিনাতে উপস্থিত রোডপসিন রাত্রে কম আলোতে দেখতে সাহায্য করে। এছাড়া ভিটামিন A এর অভাবে চোখের সাদা অংশে উঁচু, ফোনার মত সাদা বৃদ্ধি দেখা যেতে পারে। এগুলি জেরপথ্যালমিয়া বা রাতকানা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ।
ভিটামিন A এর অভাব দূর করতে ভিটামিন A সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবুজ শাকসবজি, হলুদ ও কমলা রঙের শাকসবজি ইত্যাদি গ্রহণ করতে হবে। দেহে ভিটামিন A এর অভাব না থাকলে ভিটামিন A যুক্ত সম্পূরক বা ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ অতিরিক্ত ভিটামিন A গ্রহণ করলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে।