মুত্রের সাধারণ পরীক্ষা। Urine for R E Test
মূত্রের রুটিন টেস্ট বলতে আমরা কি বুঝি? What is Urine Routine Test?
আসলে মূত্রকে বলা হয় লিকুইড টিস্যু বায়োপসি অফ ইউরিনারি ট্র্যাক। (liquid tissue biopsy of urinary tract) অর্থাৎ ইউরিনারি ট্র্যাক এর বায়পসি করলে যা জানা যাবে, তার অনেকটা ধারণা পেতে পারি মূত্রের রুটিন টেস্টের (Urine for Routine Test) মাধ্যমে। আর এই টেস্টের মধ্যে অনেকগুলি টেস্ট সম্মিলিত থাকে। তাই এই পরীক্ষার সাহায্যে আমাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ভালো তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোন জ্বর বা জ্বালা হয়েছে কিনা, বা কোন স্থানে ইনফেকশন হয়েছে কিনা, ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো তথ্য পাওয়া যায়।
কখন ইউরিনারি টেস্ট করতে দেওয়া হয়? When to get tested Urine for RE?
যদি আপনার ডাক্তার মনে করে যে আপনার ইউরিনের ট্র্যাক্টে কোন ইনফেকশন হয়েছে, (Urinary Tract Infection) বা আমাদের মেটাবলিক সিস্টেমে (Metabolic System) কোন সমস্যা হয়েছে, অর্থাৎ তন্ত্রঘটিত রোগের ক্ষেত্রে এই টেস্ট করার প্রয়োজন হয়। যে সকল ইনফেকশন বা রোগের কারণে মুত্রের সাধারণ পরীক্ষা Urine R E Test করার প্রয়োজন হয় সেগুলি হল, প্রোটিনইউরিয়া Proteinuria অর্থাৎ মূত্রের মধ্যে প্রোটিন উপস্থিতি আছে কিনা সেটা দেখা হয়। গ্লুকোসুরিয়া Glycosuria অর্থাৎ মূত্রের মাধ্যমে গ্লুকোজ বা শর্করা অর্থাৎ সুগার বেরিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও দেখা যায়। দেখা হয় কিটোন বডি অর্থাত কিনোনইউরিয়া Ketonuria হয়েছে কিনা অর্থাৎ কোন কিটন বডি মূত্রের মধ্যে উপস্থিত আছে কিনা।
রক্তপাত হচ্ছে কিনা অর্থাৎ মুত্রের মধ্যে হিমোগ্লোবিন Hemoglobin উপস্থিত আছে কিনা সেটাও দেখা হয়। এছাড়া দেখা হয় মূত্রের মধ্যে বিলিরুবিন Bilirubin আছে কিনা অর্থাৎ লিভারের রোগ, হেপাটাইটিস এ বি সি Hepatitis ইত্যাদি লিভারের রোগ বা অবস্ট্রাক্টিভ জন্ডিস Obstructive Jaundice হলে মূত্রের মধ্যে বিলিরুবিন উপস্থিত থাকতে পারে। এছাড়া দেখা হয় কোনো ধরনের কাস্ট Casts আছে কিনা, কোন ক্রিস্টাল Crystal আছে কিনা, কোন ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি। এছাড়া কোন ফাংগাল ইনফেকশন হয়েছে কিনা সেটা মুত্রের রুটিন টেস্ট Urine for R E করে বোঝা যায়।
মেটাবলিক ডিজিজ, যেমন সুগার অর্থাৎ ডায়াবেটিস হলে মুত্রের রুটিন টেস্ট করা খুব প্রয়োজন। আরেকটি বিশেষ বিষয় দেখার প্রয়োজন হয়; মুত্রের রুটিন টেস্টের সময় দেখতে হয় মূত্রের মধ্যে শুক্রাণু Sperm উপস্থিত আছে কিনা। সাধারণত যে কোন তন্ত্র ঘটিত রোগ বা মেটাবলিক ডিজিজের ক্ষেত্রে মুত্রের সাধারণ পরীক্ষা Urine for R E Test করার প্রয়োজন হয়।
কিভাবে মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করা করা হয়? How is the Urine Sample Collected?
মুত্র সংগ্রহ করার দুটি নিয়ম আছে, একটি হল সিঙ্গেল স্পেসিমেন Single Specimen এবং আরেকটি হলো টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস স্পেসিমেন। (24 hour’s Specimen) সাধারণত সকাল বেলার প্রথম ইউরিন সংগ্রহ করা হয়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর, প্রথম ইউরিন পাস করার সময়, সামান্য কিছুটা মূত্র ত্যাগ করার পর, মাঝের অংশ থেকে প্রয়োজন মতো মুত্র সংগ্রহ করার দরকার হয়। শেষের অংশ এবং প্রথমের অংশ বাদ দিতে হয়। এটাকে বলা হয় মিড স্ট্রিম ইউরিন কালেকশন। ( Mid stream urine collection)
মূত্র সংগ্রহ করার পাত্র। Urine Collection Container
মুত্রের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য এমন একটি পরিষ্কার কন্টেনার অর্থাৎ পাত্র ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে মোটামুটি 100 মিলি লিটার মুত্র ধারণ করা যাবে। টোয়েন্টিফোরআওয়ার্স স্পেসিমেন কালেকশন করার জন্য একটি 5 লিটারের পরিষ্কার প্লাস্টিকের 5 লিটারের ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
24 আওয়ার ইউরিন কালেকশন করার জন্য নিয়ম মেনে চলতে হবে সেটি হল, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমে সম্পূর্ণ মূত্র ত্যাগ করতে হবে। তারপর আগামী 24 ঘন্টায় যতটা ইউরিন ত্যাগ করবে, সবটি ওই বিশেষ 5 লিটারের প্লাস্টিকের পাত্রের মধ্যে ধারণ করতে হবে। পরের দিন সকাল বেলার সম্পূর্ণ ইউরিনটাও এই পাত্রের মধ্যে সংগ্রহ করতে হবে।
যে সকল রোগী সাধারণভাবে মূত্রত্যাগ করতে পারে না বা যারা বিছানাগত,বা যারা বেড প্যান ব্যবহার করে, তাদের ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার প্লাস্টিকের বেড প্যানের মধ্যে মুত্রের নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। বেডপ্যানে মূত্র সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে, ক্যাথেটার ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে ক্যাথেটার পড়ানোর জন্য প্রশিক্ষিত নার্স বা ডক্টরের প্রয়োজন হয়।
শিশুদের মুত্র সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ছোট্ট শিশুদের মুত্র সংগ্রহ করার জন্য বিশেষ ধরনের পলিথিন ব্যাগ পাওয়া যায়, সেই ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। সমস্যা হল, এই ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে অনলাইন থেকে এই ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ কেনা যেতে পারে। মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে, মূত্র সংগ্রহ করার জন্য আরও একটু জটিল। এক্ষেত্রেও বিশেষ ধরনের প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে, যা শুধু মাত্র মেয়ে শিশুদের কথা ভেবে তৈরী করা।
কিভাবে প্রসাবের নমুনা সঞ্চয় করা যায়? How to store Urine Sample?
সংগ্রহ করা মুত্র, অবশ্যই রেফ্রিজারেট করে রাখা দরকার। না হলে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে, মুত্রের মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপাদানের পরিবর্তন ঘটে এবং মূত্রের নমুনাটি টেস্ট করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে অবশ্যই মূত্রকে রেফ্রিজারেটরের মধ্যে রাখা প্রয়োজন। ফ্রিজের মধ্যে মূত্র সঞ্চয় না করলে এক ঘন্টার মধ্যেই মূত্রের RE টেস্ট সম্পন্ন করা করতে হবে। মুত্রের নমুনা, রেফ্রিজারেটর মধ্যে দুই থেকে আট ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে রাখতে হবে। এর ফলে মূত্রের নমুনার কোন কেমিক্যাল বা ফিজিক্যাল পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ মুত্রের রুটিন টেস্ট করার পর সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে। কিন্তু মূত্র কে সম্পূর্ণরূপে জমিয়ে দেয়া চলবে না অর্থাৎ ফ্রিজ করা চলবে না।
মুত্রের RE পরীক্ষার ধরন Type of Urine R E Test.
মুত্রের রুটিন টেস্টের প্রধানত তিনটি ভাগ করা হয়। প্রথমটিকে বলা হয় ফিজিক্যাল দ্বিতীয়টি হল কেমিক্যাল এবং তৃতীয় টি হল মাইক্রোস্কোপিক্যাল।
ফিজিক্যাল পরীক্ষা Physical Exam of Urine.
প্রথমে দেখা হবে ভলিউম অর্থাৎ পরিমাণ। চব্বিশ ঘন্টার মুত্র নমুনার ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধুমাত্র সাধারণ মূত্রের নমুনায় RE টেস্ট করার জন্য ভলিউমের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। মাত্র 100 মিলি লিটার মুত্রই পরীক্ষা করার জন্য যথেষ্ট। 24 ঘন্টায়,মুত্র ত্যাগের পরিমান, দেড় থেকে আড়াই লিটার, তিন লিটার, এমনকি চার লিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে 24 ঘণ্টায়, আড়াই থেকে তিন লিটার মুত্র ত্যাগ করা হলে সব থেকে ভালো হয়। সেটাই সবথেকে নরমাল। কিন্তু কোনভাবেই যেন মুত্রের পরিমাণ 400 মিলি লিটারের কম না হয। 400 মিলি লিটারে কম মুত্র ত্যাগ হলে, তাকে বলা হয় অলিগোইউরিয়া। এটার অর্থ, আপনার কিডনি যথেষ্ট অসুস্থ।
মূত্রের পরিমাণ 24 ঘন্টায় 100 মিলি লিটারের এর কম হলে, সেটাকে অ্যানিউরিয়া বলা হয়। এ ধরনের সমস্যা হতে পার ব্লাড ট্রান্সফিউশনে কোন সমস্যা হলে অর্থাৎ রক্ত নেয়ার পর যদি শরীরের ভিতরে রক্ত জমাট বেঁধে যায় সেক্ষেত্রে। রক্ত নেওয়ার পর দেহের ভিতরে কোন বিশেষ রিঅ্যাকশনের কারণেও এই ধরনের সমস্যা হতে পারে। এটি একটি সিরিয়াস অবস্থা অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া দেখা হয় মূত্রের গন্ধ কেমন এবং এর পিএইচ অর্থাৎ এটি অ্যাসিডিক না অ্যালক্যালাইন? এর পরে দেখা হবে মূত্রের রং বা কালার। নরমাল অবস্থায় মূত্রের রং সাধারণত পেল ইয়েলো বা হালকা হলদে হয়। মুত্রের রং একেবারে সাদা হলে সেটাকে মোটেও নরমাল ভাবা যাবে না। এটা হয়, মুত্রের মধ্যে অতিরিক্ত জল থাকলে। অতিরিক্ত ডাইলুটেড অর্থাত খুব পাতলা মুত্র ডায়াবেটিস ইনসিপিটাস অর্থাৎ বহুমূত্র রোগে এবং ক্রনিক কিডনি ফেলিওর এর সংকেত বহন করতে পারে। মূত্রের রং লাল হলে তার মধ্যে রক্ত থাকার সম্ভবানা আছে। অর্থাৎ মূত্রের মধ্যে হিমোগ্লোবিন উপস্থিত থাকতে পারে বা কোন ওষুধ মিশে যাওয়ার কারণে এটা হতে পারে। বিশেষ কোনো ওষুধ খাওয়ার পর সেটি মূত্রের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে গেলে মুত্রের রং লালচে হতে পারে। কোন বিশেষ ধরনের খাবার যার মধ্যে রঙের পরিমাণ বেশি আছে, সেই ধরনের খাবার বেশি খেলে মূত্রের রং লালচে হতে পারে।
বাদামি হলুদ রংয়ের মতো মুত্র হয় জন্ডিস হলে। বাইল পিগমেণ্ট এবং বাইল সল্ট মুত্রের মধ্যে উপস্থিত থাকলে মুত্রের রং বাদামি হতে পারে। এছাড়া বাদামি কালো রঙের মূত্র, দেহের মধ্যে কোন বিষ উপস্থিত থাকলে, বিশ্বের কারণে শরীরের মধ্যে রিএকশন হলে দেখা যেতে পারে।মুত্রে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হলেও মুত্রের রং বাদামি কালো হতে পারে।
মুত্রের রং মিল্কি হোয়াইট রঙের মত অর্থাৎ দুধের মত সাদা হয় ফ্যাট বিপাকের সমস্যনিত কারণে। মূত্রের মধ্যে চর্বি জাতীয় পদার্থ বা তেল জাতীয় পদার্থ ইত্যাদি থাকলে মুত্রের রং এই ধরনের সাদা হতে পারে, দুধের মত সাদা হতে পারে।
এছাড়া দেখতে হয় মূত্র কতটা ক্লিয়ার অর্থাৎ পরিষ্কার। মুত্র সাধারনত পরিষ্কার হয় বা সামান্য ঘোলাটে হতে পারে।কিন্তু বেশি ঘোলাটে হলে মুত্রের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিত থাকতে পারে, কাস্ট বা ক্রিস্টাল উপস্থিত থাকতে পারে। ঘোলাটে মুত্র অস্বভাবিক এবং এটি ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ইনফেকশনের সংকেত বহন করে।
এরপর দেখা হবে মুত্রের গন্ধ। নরমাল মূত্র বা স্বাভাবিক মুত্র জৈব অ্যাসিডের উপস্থিতির কারণে সামান্য গন্ধযুক্ত হয়। কিন্তু মূত্রের মধ্যে সংক্রমণ হয়ে থাকলে, মূত্রনালীতে সংক্রমণ হয়ে থাকলে উগ্র গন্ধ দেখা যায়। মুত্রের মধ্যে ফলের মতো গন্ধ হতে পারে। সাধারণত কিটোন বডি থাকলে ফলের মত গন্ধ হয়। এটা বিপাকক্রিয়াজনিত কোন সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়া দেখা হয় পেসিফিক গ্রাভিটি। স্বাভাবিক অবস্থায় মূত্রের আপেক্ষিক গুরুত্ব হল 1.016 থেকে 1.025 । আপেক্ষিক গুরুত্ব পরিবেশের সার্বিক অবস্থার উপর বেশ কিছুটা নির্ভর করে। রোগী কতটা জল পান করে, পরিবেশের তাপমাত্রা কতটা আছে, রোগী কতটা পরিশ্রম করছে, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান কেমন আছে ইত্যাদির উপর আপেক্ষিক গুরুত্বের সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। অস্বাভাবিক আপেক্ষিক গুরুত্ব বলা হবে তখনই, যদি দেখা যায় মুত্রের পরিমাণ বেশি আছে অর্থাৎ মূত্রের ভলিউম বেশি কিন্তু তার সাথে আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি। এক্ষেত্রে এটি বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে। এই ধরনের অবস্থা হতে পারে ডায়াবেটিস হলে অর্থাৎ মূত্রের মধ্যে গ্লুকোজ উপস্থিত থাকলে বা মূত্রের মধ্যে দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে গেলে অর্থাৎ প্রোটিন ইউরিয়া হলে, কিডনিতে নেফ্রাইটিস হলে বা ঐ ধরনের কোন রোগে হলে।
মাইক্রোস্কোপিক্যাল এক্সামিনেশন: Microscopical Examination
মাইক্রোস্কোপিক্যাল এক্সামিনেশন করার জন্য 10ml ইউরিনকে নিয়ে, সেন্ট্রিফিউজ করা হয় এবং তার ফলে যে সেডিমেণ্ট উৎপন্ন হয়, সেটিকে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয়। অর্থাৎ নিচে তিতিয়ে পড়া উপাদানটিকে মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা হয়। মাইক্রোস্কোপিক্যাল এক্সামিনেশন যে টেকনোলজিস্ট বা ডক্টর পরীক্ষা করবেন তার দক্ষতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
এই পরীক্ষার মধ্যে আমরা পেতে পারি লোহিত রক্তকণিকা। এটা স্বাভাবিক নয় অস্বাভাবিক অবস্থা। অর্থাৎ এটি মূত্রের মধ্যে রক্তের উপস্থিতি প্রমাণ করে। মুত্রের মধ্যে কোন স্থানে ইনফেকশন হলে এই ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে। মূত্রের মধ্যে হিমোগ্লোবিন পাওয়া গেলেও বুঝতে হবে যে, মুত্রনালীর কোন স্থানে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
শ্বেত রক্তকণিকা অর্থাৎ যাকে আমরা পাস সেল বলে থাকি, সেই পস সেলও খুব গুরুত্বপূর্ণ। অল্প কয়েকটি পাস সেল খুব স্বাভাবিক। বিশেষ করে, মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা করার সময়, প্রতি হাই পাওয়ার ফিল্ডের মধ্যে এক থেকে দু’টি পাস সেলের উপস্থিতি একেবারে নরমাল বলে মনে করা হয়। কিন্তু তার বেশি অর্থাৎ দুটির বেশি পাস সেল থাকলে সেটি ইউপিনারি ট্রাক্টইনফেকশনকে নির্দেশিত করে। মূত্রের মধ্যে পাস সেল না থাকলেও সেটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয় একদম স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু পাস সেলের পরিমাণ বেশি থাকলে সেটা ব্লাডারে অর্থাৎ মুক্ত থলিতে বা মূত্রনালীতে বা কিডনিতে ইনফেকশন নির্দেশিত করে।
এছাড়া দেখা হয় এপিথেলিয়াল সেল অর্থাৎ আবরণীকলার কোষ। আবরণী কলার কোষ, অল্প পরিমাণে থাকা খুব স্বাভাবিক। বেশি হলে সেটি কোন ইনফেকশন কে নির্দেশিত করে। প্রতি হাইপাওয়ার ফ্লিডে পাঁচ থেকে সাতটি এপিথেলিয়াল সেল নরমাল মনে করা হয়। কিন্তু এর থেকে বেশি হলে এটি রেনালটি জেনারেশন অর্থাৎ কোথাও না কোথাও কোনো সমস্যা হয়েছে, মূত্রনালীতে বা কিডনিতে বা ইউরিনারি ব্লাডারে কোন সমস্যা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এবার দেখা হয় কাস্ট। কাস্ট এবং ক্রিস্টাল অল্প পরিমান উপস্থিত থাকা নরমাল। কিন্তু কাস্টের পরিমান বেশি থাকলে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বুঝতে হবে যে,কিডনির মধ্যে কোন রোগ আক্রমণ ঘটেছে বা কিডনির মধ্যে কোন সমস্যা আছে। হায়লিন কাস্ট এর মধ্যে যদি লোহিত রক্ত কণিকা লেগে থাকে বা শ্বেত রক্তকণিকা লেগে থাকে বা এপিথেলিয়াল কোষ লেগে থাকে সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। এটা কোন বড়সড় রোগ নির্দেশে করে। গ্লোমারুলের ইনজুরি কে নির্দেশিত করতে পারে, ইউরিনারি ট্রাক্টের মধ্যে সংক্রমণকে নির্দেশিত করতে পারে। অর্থাৎ এই ধরনের রিপোর্ট পাওয়া গেলে ধরে নিতেই হবে যে মূত্রনালী বা কিডনি বা ব্লাডারে কোন বড় সমস্যা হয়েছে। এছাড়া ক্রনিক নেফ্রাইটিসের ক্ষেত্রে ওয়াক্সিকাস্ট এবং ফ্যাটি অ্যাসিডকাস্ট দেখা যেতে পারে।
এবার দেখতে হবে মাইক্রো অর্গানিজম অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার মত ছোট ছোট জীবাণু। ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। স্বাভাবিক মুত্রের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া থাকা উচিত নয়। মুত্রে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে বা অল্প পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। অল্প পরিমাণের ব্যাকটেরিয়া উপস্থিত থাকলে মুত্রের কালচার করতে হবে। মুত্রে বেশি পরিমান ব্যাকটেরিয়ার থাকলে, ইউরিন ফর কালচার এন্ড সেনসিটিভিটি টেস্ট করতে হতে পারে। বেশি পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকলেও কালচার অ্যাণ্ড সাইনসিটিভিটি টেস্ট করা ভালো। কারণ এই পরীক্ষার সাহায্যে, কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, সেটা সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা ল্যাবরেটরি থেকেই পাওয়া যায়। মুত্রে ইনফেকশনের প্রথম সংকেত দেবে ইউরিনারি RE টেস্ট। যদি এখানে সংকেত পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ইউরিন কালচার অ্যাণ্ড সেনসিটিভিটি টেস্টের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এছাড়া মূত্রের মধ্যে ফাংগাস থাকতে পারে। মুত্র নালীতে কোন ফাংঘাসের সংক্রমণ হলে ফাঙ্গাস দেখতে পাওয়া যায়। Candida গ্রুপের কিছু ফাংগাস মূত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটায়। আর মেয়েদের মূত্রের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে এক ধরনের প্রোটোজোয়া, ট্রাইক্রোমোনাস ভ্যাজাইনেলিস। এরা যোনির মধ্যে বসবাস করে। পুরুষদের মুত্রে এটা সাধারণত দেখা যায় না। তবে একেবারেই অনুপস্থিত থাকবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। কখনো কখনো মেয়েদের মতো পুরুষদের মধ্যেও এই সংক্রমণ হতে পারে।
এবার দেখব ক্রিস্টাল বা কেলাস। বিভিন্ন ধরণের কেলাস থাকতে পারে। যেমন ক্যালসিয়াম অক্সালেট, সোডিয়াম ইউরিয়াট, ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল, অ্যামোনিয়াম ইউরেট ক্রিস্টাল ইত্যাদি। কিডনিতে স্টোন বা পাথর হওয়ার সাথে ক্রিস্টাল গুলির সম্পর্ক আছে। ক্রিস্টাল আছে মানে পাথর হয়েছে বা স্টোন হয়েছে এমন কথা নয়। কিন্তু ক্রিস্টাল উপস্থিত আছে মানে কিডনির মধ্যে স্টোন হওয়ার সম্ভাবনাটা অনেক বেশি।
মূত্রের রাসায়নিক পরীক্ষা Chemical Examination of Urine
প্রথমে দেখা হয, মূত্রের pH, অর্থাৎ মুত্র অ্যাসিটিক না অ্যালকালাইন? এটা কেমিক্যাল এক্সামিনেশন এর মধ্যেই পড়ে। মুত্র সাধারণত অ্যাসিডিক হয়। কখনো কখনো মূত্র অ্যালকালাইনও হতে পারে। আবার অ্যাসিডিক ইউরিনকে বেশ কিছুক্ষণ রেখে দিলে সেটি অ্যালকালাইন হয়ে যায়।
কেমিক্যাল এক্সামিনেশন এর মধ্যে বিশেষভাবে দেখা হয় মূত্রে গ্লুকোজ উপস্থিত আছে কিনা। এর জন্য একটা বিশেষ টেস্ট করা হয়। খুব সামান্য পরিমাণ গ্লুকোজের উপস্থিতিও একেবারেই অস্বাভাবিক। ডায়াবেটিস রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহে, মূত্রে গ্লুকোজ উপস্থিত থাকে থাকতে পারে।
মুত্রে সাধারণত প্রোটিন অনুপস্থিত থাকে। শুধুমাত্র গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণে থাকতে পারে অর্থাৎ ট্রেস এমাউন্ট থাকতে পারে। কিন্তু অন্য সকল রোগীদের ক্ষেত্রে এটা অস্বাভাবিক বা অ্যাবনরমাল। খুব সামান্য পরিমাণে থাকলে, ট্রেস থাকলে নরমাল বলা যায়। কিন্তু তার থেকে সামান্য বেশি হলে অর্থাৎ ওয়ান প্লাস, টু প্লাস, হলেই সেটা অস্বাভাবিক বলা হয়। তবে ট্রেস পরিমান থাকলেও ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়া ভীষণ জরুরী। মূত্রের মধ্যে বেশি পরিমাণে প্রোটিন থাকা খুব বড়সড়ো রোগকে নির্দেশিত করে। এটা মোটেই ভালো সংকেত নয়। একে প্রোটিনইউরিয়া বলে।
এছাড়া বেন জনস্ প্রোটিন নামক এক ধরনের প্রোটিন টেস্ট করা যেতে পারে। এটি মুত্রের RE টেস্টের মধ্যে সাধারণত করা হয় না। এটা এক ধরনের স্পেশাল টেস্ট। এই বেন জনস্ প্রোটিন উপস্থিত থাকলে, মাল্টিপল মায়োলোমা নামক রোগেকে নির্দেশিত করে। মাল্টিপল মায়োলোমা হলো এক ধরনের ক্যানসার।
এছাড়া মুত্রের মধ্যে থাকতে পারে কিটোন বডি। এটি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। কোন বিপাকক্রিয়া ঘটিত রোগে এটি থাকতে পারে। কিটোন বডির উপস্থিতি ও জটিল সমস্যার ঈঙ্গিত বহন করে।
বিলিরুবিন থাকাটাও অস্বাভাবিক। বিলিরুবিন থাকতে পারে হেপাটিক জন্ডিস হলে এবং অবস্টাকটিভ জণ্ডিশ হলে। অর্থাৎ লিভার অসুস্থ হলে এবং লিভারের মধ্যে বা পিত্তথলির মধ্যে কোন স্টোন বা অন্য কোন বাধার সৃষ্টি হলে। বিলিরুবিন স্বাভাবিকভাবে যে পথ দিয়ে শরীরের বাইরে বেরিয়ে যায় অর্থাৎ পোষ্টিকতন্ত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়, সেই পথ দিয়ে কোন কারনে বাইরে বেরোতে না পারলে বিলিরুবিনের পরিমাণ রক্তের বৃদ্ধি পায় এবং সেটি মূত্রের মাধ্যমে শরীরের বাইরে নির্গত হয়।
এছাড়া দেখা হয় ইউরোবিলিনোজেন। নরমাল ইউরিনে অল্প পরিমাণে ইউরোবিলিনোজেন থাকে, কিন্তু বেশি পরিমাণ উপস্থিত থাকলে সেটা জন্ডিসকে নির্দেশিত করে। আবার সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত থাকাটাও আরেক ধরনের জন্ডিসকে নির্দেশিত করতে পারে। জণ্ডিশ সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।