Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাপন্য Productসংবাদ News

ভ্যাকসিন কী? ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করে? What is a vaccine? How does the vaccine work?

ভ্যাকসিন কী? ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করে? What is a vaccine? How does the vaccine work?

আমাদের চারিপাশে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব বা মাইক্রোবস সকল সময় অবস্থান করে। এদের মধ্যে বেশ কিছু অনুজীব আমাদের দেহের বাইরে বা ভিতরে যথাক্রমে বহিঃপরজীবী বা অন্তপরজীবী রূপে বাস করে। কোন কোন পরজীবী আমাদের উপকার করতে পারে। আবার বেশ কিছু পরজীবী আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে; এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এই সকল রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর হাত থেকে আমাদের দেহকে রক্ষা করার জন্য আমাদের দেহে একটি ব্যবস্থা আছে। রোগ প্রতিরোধকারী, জীবাণু ধ্বংসকারী এই ব্যবস্থাটি কে বলা হয় অনাক্রম্য তন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম। এই অনাক্রম্য তন্ত্র বা ইমিউন সিস্টেম থাকার জন্যই আমরা সহজে অসুস্থ হয়ে পড়ি না।

ভ্যাকসিন বা টীকার সাহায্যে কিভাবে আমরা রোগ জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি, সেটাই হল এই প্রতিবেদনের আলোচনার বিষয়।

কিভাবে ভ্যাকসিন কাজ করে? How does the vaccine works?

ভ্যাকসিনের সাহায্যে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলা হয়। এর ফলে দেহে রোগজীবাণু প্রবেশ করার সাথে সাথেই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঐ নির্দিষ্ট জীবণুটিকেকে ধ্বংস করতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যাতে জীবাণুকে চিনতে পারে তার জন্য মৃত বা জীবিত কিন্তু নিষ্ক্রিয় বা  সংক্রমণ ক্ষমতাহীন অনুজীবের সাসপেনশন বা নীলম্বন ব্যবহার করা হয়। এই সাসপেনশন অ্যান্টিজেন রূপে কাজ করে। বহিরাগত প্রোটিন ধর্মী বা পলিস্যাকারাইড জাতীয় পদার্থ, যা আমাদের অনাক্রম্য তন্ত্রকে উদ্দীপিত করতে পারে, তাকে অ্যান্টিজেন বলে। এই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য আমাদের দেহে যে প্রোটিন জাতীয় পদার্থ উৎপন্ন হয়, তাকে অ্যান্টিবডি বলে। ভ্যাকসিনের সাহায্যে আমরা কৃত্রিম ভাবে কোন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার উপযোগী অ্যান্টিবডি উৎপাদন করি। ঐ নির্দিষ্ট জীবণুটি শরীরে আক্রমণ করলে, আগে থেকে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ওই জীবাণুকে ধ্বংস করে আমাদের রক্ষা করে।

হার্ড ইমিউনিটি অর্থাৎ দলগত অনাক্রম্যতার গুরুত্ব: The Herd Immunity Imprrative:

রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন (Vaccine) ব্যক্তিগত সুরক্ষা দেওয়ার সাথে সাথে দলগত সুরক্ষাও দেয়। সমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন দিলে যে সকল ব্যক্তি ভ্যাকসিন নেয়নি তারাও উপকৃত হয়। বেশিভাগ ব্যক্তি ভ্যাকসিন দ্বারা সুরক্ষিত হলে, রোগ জীবাণু, আক্রমণ করার মত উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে পায় না। ফলে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে না এবং ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়াকে হার্ড ইমিউনিটি বা দলগত অনাক্রমতা বলে।

সমাজে বেশ কিছু ব্যক্তি থাকে যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয় না। শিশুদের, বয়স্ক ব্যক্তিদের, যাদের মাত্রাতিরিক্ত এলার্জির সমস্যা আছে তাদের, গর্ভবতী মহিলাদের এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোনো সমস্যা আছে তাদের অনেক সময় ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি এই সকল ব্যক্তিদের রোগের হাত থেকে রক্ষা করে।

হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার জন্য কত শতাংশ ব্যক্তি কে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন সেটা এখনও গবেষণার বিষয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, গাম্বিয়াতে 70% ব্যক্তিদের হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে রোগটি দেশ থেকে লুপ্ত হয়েছে। তবে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, বেশিভাগ ব্যক্তি যদি ভ্যাকসিন না নেয়, সেক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে না বা তৈরি হলেও সহজে ভেঙে পড়বে এবং আবার রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পড়বে।

ভ্যাকসিনের প্রকারভেদ: Types of Vaccines:

যে রোগের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করবে সাধারণত সেই রোগের জীবাণুকেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয়। জীবাণুর কোন অংশটি কিভাবে ব্যবহার করা হয়, তার ওপর নির্ভর করে ভ্যাকসিনের প্রকারভেদ করা হয়।

1) অ্যাটিনিউয়েটেড (Attenuated)

এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া একটি দুর্বল প্রকারকে দেহে প্রবেশ করানো হয়। জীবাণুটি জীবিত অবস্থায় প্রবেশ করালেও এটি দুর্বল হওয়ার কারণে রোগ সৃষ্টি করতে পারেনা। কিন্তু আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দিপিত হয় এবং জীবাণুটি পরবর্তীকালে প্রবেশ করে যাতে রোগ সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

অ্যাটিনিউয়েটেড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যেহেতু জীবিত জীবাণু ব্যবহার করা হয়; তাই এই ভ্যাকসিনের দ্বারা খুব ভালো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। একটি বা দুটি ডোজ ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি সারা জীবনব্যাপি কার্যকর ইমিউনিটি গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

জীবিত জীবাণু থাকার কারণে সকল ব্যক্তিকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয় না। যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভালো নয়, যাদের কেমোথেরাপি চলছে, যারা এইচ আই ভি রোগের চিকিৎসা করাচ্ছেন তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া যায় না। এটি স্টোর করতে হয় রেফ্রিজারেটরে। কারণ কম তাপমাত্রায় না রাখলে এই ভ্যাকসিনে অবস্থিত জীবাণুর মৃত্যু ঘটে এবং ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। মামস, মিজেল, রুবেলা, ভেরিসেলা অর্থাৎ চিকেন পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, রোটা ভাইরাস, পোলিও ইত্যাদি রোগে অ্যাটিনিউয়েটেড ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।

2)  মৃত বা নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিন: (Inactivated Vaccines)

এই ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে তাপ প্রয়োগ করে বা রাসায়নিক প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করে তোলা হয়। এবার এই মৃত জীবাণুর দেহাবশেষকে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জীবাণু মৃত হওয়া সত্ত্বেও জীবাণুর দেহাবশেষ আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপিত করে এবং আমাদের ইমিউন সিস্টেম পরবর্তীকালে কিভাবে জীবাণুর সাথে লড়াই করবে সেটা শিখে রাখে।

এই প্রকার ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সংরক্ষণ করা সহজ। সকলকে এই ধরনের ভ্যাকসিন দেওয়া যায় কারণে এই ভ্যাকসিন থেকে রোগ সৃষ্টি হয়ে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই।

যেহেতু এই ধরনের উৎপাদন করতে মৃত জীবাণুর অবশেষ ব্যবহার করা হয়, সে কারণে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম খুব ভালো উদ্দীপিত হয়না এবং কাম্য রেগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অনেকগুলি ডোজের প্রয়োজন হয়। জলাতঙ্ক রোগের টীকা, সাক পোলিও ভ্যাকসিন, হেপাটাইটিস এ ইত্যাদি হল এই জাতীয় ভ্যাকসিন (Vaccine)।

3)  টক্সয়েড ভ্যাকসিন: (Toxoid Vaccines)

কিছু ব্যাকটেরিয়া বা রোগ জীবাণু আছে যারা তাদের দেহ থেকে টক্সিন বা বিষ নিঃসরণ করে এবং আমাদের রোগাক্রান্ত করে তোলে। এই সকল টক্সিন কে রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা নিষ্ক্রিয় করে ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। নিষ্ক্রিয় এই নিষ্ক্রিয় মৃত টক্সিন বা বিষ আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করতে পারে। এর ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, কিভাবে প্রকৃত টক্সিন বা জীবিত টক্সিনকে ধ্বংস করতে হবে, সেটা শিখে ফেলে এবং আমাদের রোগের হাত থেকে রক্ষা করে।

ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ইত্যাদি রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে এই ধরনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।

4)  উপাদান সমূহ দ্বারা নির্মিত ভ্যাকসিন: (Conjugate Vaccine)

এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের বিশেষ কিছু উপাদানকে আলাদা করে, সেই উপাদান গুলির মধ্যে যে প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেট অংশটি আমাদের ইমিউন সিস্টেম কে উদ্দীপ্ত করতে পারে সেটা ব্যবহার করে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়।

এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত ভ্যাকসিন থেকে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তবে এই প্রক্রিয়ায় ভ্যাকসিন উৎপাদন করা সহজসাধ্য নয়। দীর্ঘ গবেষণার পর সাফল্য পাওয়া যায়।

হেপাটাইটিস বি, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি, নিউমোকক্কাল, হাম, প্যাপিলোমা ভাইরাস ইত্যাদি রোগ দমনে কনজুগেটেড পদ্ধতিতে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।

5)  ডি এন এ ভ্যাকসিন: D N A (Vaccines)

এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন উৎপাদন করার জন্য জীবাণু অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলিকে সরিয়ে রেখে, কেবলমাত্র জীবাণুর নিউক্লিক অ্যাসিডের অর্থাৎ ডি এন এ বা আর এন এ এর সামান্য কিছু অংশে, ইনজেকশনের মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করানো হয়। নিউক্লিক অ্যাসিডের এই অংশটি দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারেনা, কিন্তু আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে রোগাক্রান্ত হওয়ার সংকেত দেয়। ফলে ইমিউন সিস্টেম, দেহ রোগাক্রান্ত হয়েছে ভেবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এই ভ্যাকসিন খুবই কার্যকরী এবং উৎপাদন করাও সহজসাধ্য। ডি এন এ ভ্যাকসিন উৎপাদনের খরচও কম। ইনফ্লুয়েঞ্জা, হারপিস ইত্যাদি রোগ দমনে এই ধরণের ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়।

6) রিকম্বিনেন্ট ভেক্টর ভ্যাকসিন: (Recombinant Vector Vaccine)

এই ভ্যাকসিন অনেকটা ডি এন এ ভ্যাকসিনের মত। এক্ষত্রে জীবাণুটির ডি এন এ কে বহন করার জন্য একটি কম ক্ষতিকর জীবিত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। এর ফলে দেহের ইমিউন সিস্টেমকে খুব ভালোভাবে ও সহজে ট্রেনিং দেওয়া যায় ও রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

 বর্তমানে এই পদ্ধতিতে এইচ আই ভি, জলাতঙ্ক, মিজেল ইত্যাদি রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হয়।