রক্ত পরীক্ষা Blood Test

ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট। Uric Acid Test

ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট। Uric Acid Test

বৃক্কে পাথর বা বাতের সমস্যার মূল কারণ ইউরিক অ্যাসিড। এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রথম ধাপ হল ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা। কখন কিভাবে এবং কী নিয়ম মেনে ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করা উচিত, সেটাই এই প্রতিবেদনের আলোচনা।

কী পরীক্ষা করা হয়? What is being tested?

আমাদের দেহ কোশে পিউরিন Purine নামক নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব পদার্থ থাকে। এই পিউরিন রাসায়নিকভাবে ভেঙে গিয়ে ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে। দেহের কোষ বৃদ্ধ হলে ভেঙে যায় এবং রক্তে পিউরিন নির্গত হয়। অল্প পরিমাণে পিউরিন আমাদের খাদ্য থেকে রক্ত পৌঁছায়। রাসায়নিক ভাবে জাতীয় মাংস থেকে, রাসায়নিক ভাবে জাতীয় মাছ বা অন্য সামুদ্রিক মাছ থেকে পিউরিন আমাদের দেহে প্রবেশ করে। এছাড়া মটর ছোলা ইত্যাদি ডাল শস্য থেকে আমাদের রক্তে পিউরিন প্রবেশ করে।

কেন ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষা করা হয়? Why get tested for Uric Acid?

রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা, সেটা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়। Gout অর্থাৎ বাত নামক রোগে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি করার সময় শারীরিক অবস্থা কেমন আছে সেটা জানার জন্য এই টেস্ট করা হয়। বৃক্ক অর্থাৎ কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করে বৃক্কের স্বাস্থ্য দেখে নেওয়া যায়। ডাক্তারবাবু রোগীর দেহে বাতের কোন লক্ষণ দেখতে পেলে, গাঁটে গাঁটে ব্যথা ও ফোলা থাকলে, ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষা করতে দিয়ে থাকেন। এছাড়া কিডনি অর্থাৎ বৃক্কে পাথর থাকলে, চিকিৎসা চলাকালীন ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করতে হয়।

ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষা করার আগে প্রস্তুতি। Preparation before testing Uric Acid.

কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। কিছু কিছু ল্যাব ল্যাবরেটরি 8 থেকে 10 ঘণ্টা উপবাস করার কথা বলেন। ল্যাবরেটরির সাথে এ ব্যাপারে কথা বলুন ও তাদের নির্দেশ মেনে চলুন।

ইউরিক অ্যাসিড টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ। How to collect samples for the Uric Acid Test?

রক্তের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ পরীক্ষা করার জন্য, সাধারণত হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়।

মূত্রে ইউরিক এসিডের উপস্থিতি পরীক্ষা করার জন্য, পরিষ্কার কাচ বা প্লাস্টিকের পাত্রে মূত্র সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে অল্প কিছুটা মূত্র ত্যাগ করার পর মূত্র সংগ্রহ করতে হয়। অর্থাৎ মিড স্ট্রিম ইউরিন সংগ্রহ করতে হয়। অল্প একটু মূত্রই পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।

রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মান। Normal Level of Uric Acid in Blood.

মহিলাদের ক্ষেত্রে 2.5 থেকে 6 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটার। Women 2.5 to 6 mg/dL

পুরুষদের ক্ষেত্রে 3.4 থেকে 7 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটার। Men 3.4 to 7 mg/dL

মূত্রে ইউরিক অ্যাসিডের স্বাভাবিক মান। Normal Level of Uric Acid in Urine.

250 থেকে 750 মিলিগ্রাম প্রতি 24 ঘণ্টা। (1.48 থেকে 4.43 মিলি মোল প্রতি 24 ঘণ্টা)

বিশেষ ধরনের কিছু খাবার আছে, যেগুলি খাদ্য তালিকায় থাকলে, রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা থাকে। কিছু রোগেও ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত পরীক্ষা পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, রিপোর্টে নরমাল লেভেল উল্লেখ করা থাকে। রিপোর্ট লেখা নরমাল লেভেল মেনে চলুন।

পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাখ্যা। What does the Uric Acid test result mean?

রক্তে স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশি ইউরিক অ্যাসিড থাকাকে হাইপারইউরেসেমিয়া Hyperuricemia বলা হয়। শরীর বেশি পরিমাণ ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন করলে হাইপারইউরেসেমিয়া হতে পারে। বৃক্ক অর্থাৎ কিডনি যদি সঠিকভাবে ইউরিক অ্যাসিডকে শরীর থেকে মূত্রের মাধ্যমে বাইরে নির্গত করতে না পারে, সেক্ষেত্রেও হাইপার ইউরেসেমিয়া হতে পারে। কি কারণে ইউরিক অ্যাসিড রক্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটা সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন।

জন্মগত-ভাবে জেনেটিক ত্রুটি থাকার কারণে পিউরিন ভাঙ্গনে সমস্যা হতে পারে। এই ত্রুটির কারণে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে। ক্যান্সার নামক রোগ ছড়িয়ে পড়লে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। মাল্টিপল মায়োলোমা (Multiple Myeloma), মেটাস্ট্যটিক ক্যানসার (Metastatic Cancer), লিউকেমিয়া(Leukemia) ইত্যাদি রোগে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে কেমোথেরাপি ব্যবহার করলেও রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। ক্রনিক রেনাল ডিজিজ Chronic Renal Disease অর্থাৎ বৃক্কের রোগে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়। অ্যাসিডোসিস Acidosis অর্থাৎ রক্তে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে, প্রিক্ল্যামসিয়া Preeclampsia অর্থাৎ গর্ভবতী মায়েদের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ও মূত্রে প্রোটিন নির্গত হওয়া সহ জীবনহানিকর রোগে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। অ্যালকোহল পানের ফলে শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিড নির্গত হতে বাধা পায়, ফলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়।
যারা উচ্চ পিউরিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করে, তাদের মূত্রেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ইউরিক অ্যাসিড পাওয়া যেতে পারে।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পেলে ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টাল সৃষ্টি হতে পারে। এই ক্রিস্টালগুলি Joint অর্থাৎ অস্থিসন্ধিতে জমা হয়। এ কারণে অস্থিসন্ধি ফুলে ওঠে ও ব্যথার সৃষ্টি হয়। এটাই হল গাউট Gout অর্থাৎ বাত। ইউরিক অ্যাসিড কিডনি অর্থাৎ বৃক্কে পাথরের সৃষ্টি করতে পারে। আমেরিকান কলেজ অফ রিউমাটোলজির মতে বাতকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ 6 মিলিগ্রাম প্রতি ডেসি লিটারের ( 6 mg/dL) এর নিচে রাখতে হবে।

রক্তে নরমাল লেভেলের কম ইউরিক অ্যাসিড খুব একটা দেখা যায় না। এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে যকৃত অথবা বৃক্কের রোগে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
দীর্ঘদিন অ্যালকোহল পান করলে, বৃক্কের রোগে ও Lead Poisoning এ মূত্রে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ স্বাভাবিক অপেক্ষা কম হতে পারে।

মন্তব্য Remarks about Uric Acid Test

বেশ কিছু ওষুধ আছে যা রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণকে প্রভাবিত করে। ডাইইউরেটিক diuretic drugs অর্থাৎ যে সকল ওষুধ খেলে শরীর থেকে বেশি পরিমাণে জল মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়, সেই সকল ওষুধ সেবনে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। কম পরিমাণ অ্যাসপিরিন Aspirin সেবন করলে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়; কিন্তু বেশি পরিমাণ সেবন করলে ইউরিক এসিডের পরিমাণ কমে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস Rheumatoid Arthritis রোগের চিকিৎসায় বেশি পরিমাণ অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা হয়।

যাদের কিডনিতে স্টোন Kidney Stone আছে বা যাদের বাতের সমস্যা আছে, তাদের উচ্চপিউরিনযুক্ত খাবার না খাওয়া উচিত। সামুদ্রিক মাছ ও মাংস, বিশেষ করে লিভার অর্থাৎ যকৃত খাওয়া উচিত নয়। অ্যালকোহল পান করলে শরীর থেকে ইউরিক অ্যাসিডের নির্গমন বাধা পায়, সেকারণে অ্যালকোহল পানের অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত।

অনাহারে থেকে তাড়াতাড়ি ওজন কমানোর চেষ্টা করলে, অতিরিক্ত মানসিক চিন্তা করলে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত ব্যায়ামও ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
বাতের রোগ হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করা হয়। তবে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড অর্থাৎ হাড়ের সন্ধিতে যে তরল থাকে, তার মধ্যে মনোসডিয়াম ইউরেটের কেলাস অর্থাৎ ক্রিস্টালের উপস্থিতি পরীক্ষা করে, বাত হয়েছে কিনা সঠিকভাবে বলা সম্ভব।

কিছু ব্যক্তি আছে যাদের ইউরিক এসিডের পরিমাণ বেশি থাকলেও তেমন কোন রোগ লক্ষণ দেখা যায় না। এটা খুব কম ক্ষেত্রে ঘটে। এদের কোন চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তবে পরিবারে কারো যদি বাত, বৃক্কে পাথর ইত্যাদি রোগ থেকে থাকে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসা করা উচিত।