ল্যাব টেস্ট Lab Test

কিডনি পরিষ্কার বা ডিটক্স করার উপায় কী?: How To Cleanse The Kidney?

আমাদের কিডনি আমাদের রক্তকে ফিল্টার করে শরীরে উৎপন্ন  বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করে। এছাড়া আমাদের কিডনি লোহিত রক্ত কণিকার উৎপাদনে সাহায্য করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও হরমোন তৈরি করে। কিছু খাবার, পানীয় এবং ভেষজ পদার্থ আমাদের কিডনি ডিটক্স করতে অর্থাৎ পরিষ্কার করতে সাহায্য করতে পারে। এই প্রতিবেদনে কিডনি পরিষ্কার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

কিডনি বেশ ছোট্ট একটি অঙ্গ। আমাদের দেহে সাধারণত দুটি কিডনি থাকে। কিডনির প্রধান কাজ হল আমাদের রক্তকে ফিল্টার করা। রক্ত থেকে বিপাক-জাত দূষিত পদার্থ শরীরের বাইরে নির্গত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে কিডনি। শরীরে জল ও ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে কিডনি। এছাড়া কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও হরমোন উৎপাদন করে।

কিডনি রোগাক্রান্ত হলে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ ও বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করতে পারেনা। শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমা হলে  লিভার সহ অন্যান্য অঙ্গের স্বাভাবিক কাজ বাধা পায়। ফলে ক্লান্তি, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, শরীরে জল জমা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। দেহে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ জমা হওয়ার কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে ও জটিল সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

কিডনি একটি জটিল অঙ্গ। কিডনি পরিষ্কার করা বলতে যান্ত্রিক উপায়ে ধোঁয়া মোছা বোঝায় না। কিছু খাবার, পানীয় ও উন্নত জীবনযাত্রা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের কিডনি পরিষ্কার রাখতে পারে। কিডনি পরিষ্কার ও সুস্থ রাখতে পারলে কিডনির কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ফোলা ভাব কমে। কিডনি সুস্থ থাকলে খাদ্যের পরিপাক ও শোষণ ভাল হয় এবং ক্লান্তি দূর হয়। দেহের বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে মূত্রনালি ও মূত্রাশয়ে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে। এছাড়া কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে, রক্ত উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা পায়। কিডনি সুস্থ থাকলে ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত হয় এবং একজিমা (Eczema), ব্রণ, ফুসকুড়ি ইত্যাদি সমস্যা কমে।

শরীর থেকে টক্সিন বা বিষ অপসারণ করার ও কিডনি পরিষ্কার করার উপায় গুলি নিয়ে আলোচনা করা হল।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরের 60 শতাংশই হল জল। মস্তিষ্ক থেকে লিভার প্রত্যেকটি অঙ্গের কাজ করার জন্য জলের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রস্রাব উৎপাদনের জন্য জলের প্রয়োজন কারণ প্রস্রাবের মাধ্যমে কিডনি শরীর থেকে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন করে।

জল কম খেলে প্রস্রাবের পরিমাণ কম হয়। এর ফলে মূত্রের উৎপাদন কমে গিয়ে কিডনির ক্ষতি হতে পারে। পর্যাপ্ত জল পান করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে। তবে অতিরিক্ত জল পান করা কখনোই উচিত নয়। ইন্সটিটিউট অফ মেডিসিনের মত অনুসারে প্রতিদিন পুরুষদের 3.7 লিটার এবং মহিলাদের 2.7 লিটার জল পান করা উচিত।

আঙ্গুর, চিনা বাদাম এবং কিছু বেরি জাতীয় ফলে রেসভেরাট্রল (Resveratrol) নামক উপকারী যৌগ থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে রেসভেরাট্রল কিডনির প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। একারণে এই ধরনের ফল গ্রহণ করা কিডনির জন্য বেশ ভাল। বিশেষ করে লাল আঙ্গুর খুব ভাল।

ক্র্যানবেরি (Cranberries) মূত্রনালির সংক্রমণের (UTI) চিকিৎসায় যথেষ্ট ভাল ফল দেয়। নিউট্রিশন জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে যে, নিয়মিত ক্র্যানবেরি গ্রহণ করলে মূত্রনালির সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে।

কমলা, লেবু, তরমুজ ইত্যাদি ফলের রসে সাইট্রিক অ্যাসিড বা সাইট্রেট থাকে। সাইট্রেট, মূত্রে উপস্থিত ক্যালসিয়ামের সাথে আবদ্ধ হয়ে কিডনিতে পাথর সৃষ্টিতে বাধা দেয়। এটি ক্যালসিয়ামের ক্রিস্টাল তৈরিতে বাধা দেয় অর্থাৎ পাথর হতে দেয় না। তাই প্রতিদিন এক কাপ তাজা ফলের রস পান করা উচিত।

বাদামী সামুদ্রিক শৈবাল অগ্ন্যাশয়, কিডনি এবং লিভারের জন্য উপকারী। 2014 সালের একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, সামুদ্রিক শৈবাল খেলে লিভার ও কিডনির ক্ষতি হ্রাস পায়। তাই খাদ্যে সামুদ্রিক শৈবালের ব্যবহার শুরু করা দরকার।

আমরা অনেকে মনে করি যে, ক্যালসিয়াম কম খেলে কিডনিতে পাথর হবে না। বাস্তবে এটি একটি ভুল ধারণা। প্রস্রাবে অত্যধিক অক্সালেট নির্গত হলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে অক্সালেটের সাথে ক্যালসিয়াম যুক্ত হয় এবং পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমে। অবশ্যই প্রতিদিন উচ্চ ক্যালসিয়াম যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিন 1.2 গ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে হবে।

হাইড্রেঞ্জা (Hydrangea) হল একপ্রকার গুল্ম জাতীয় ফুল গাছ। গোলাপি, নীল, সাদা ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের হাইড্রেঞ্জা দেখা যায়। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, হাইড্রেঞ্জার নির্যাসে খুব কার্যকরী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার জন্য হাইড্রেঞ্জার নির্যাস যুক্ত চা পান করলে কিডনির ইনফেকশন কমে। কিডনির ক্ষতি-রোধ করতে বেশ ভাল কাজ করে হাইড্রেঞ্জা যুক্ত চা।

স্যামবং (Sambong) হল একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। আফ্রিকা, চীন, ফিলিপিন্স, ভারত ইত্যাদি স্থানে স্যামবং একটি ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মূত্রনালির ইনফেকশন সারাতে স্যামবং বেশ ভাল কাজ করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, স্যামবং কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। স্যামবং যুক্ত চা পান করলে কিডনি সুস্থ থাকে।

ভিটামিন B 6 অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান। দেহে ভিটামিন B 6 এর অভাব হলে অত্যধিক মাত্রায় অক্সালেট (Oxalate) উৎপন্ন হতে পারে। এর ফলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। প্রতিদিন কমপক্ষে 50 মিলিগ্রাম ভিটামিন B 6 গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আধুনিক গবেষণায় জানা গিয়েছে যে ওমেগা 6 ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি গ্রহণ করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ওমেগা 3 যুক্ত খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করলে এই সমস্যা কমে। ওমেগা 6 এবং ওমেগা 3 সমান সমান হলে ভাল হয়।

দেহে ইলেক্ট্রোলাইট ও pH এর ভারসাম্য রক্ষা করতে পটাশিয়াম খুব গুরুত্বপূর্ণ। পটাশিয়াম সাইট্রেট (Potassium Citrate) দিয়ে চিকিৎসা করলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কমে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পটাশিয়াম সম্পূরক গ্রহণ করা উচিত নয়। এছাড়া দৈনিক মাল্টি-ভিটামিন গ্রহণ করলেও কিডনির উপকার হয়।

বেশিভাগ সুস্থ মানুষের কিডনি ফ্লাশ বা পরিষ্কার করার কোন প্রয়োজন হয়না। তবে উপকারী খাদ্য, ভেষজ চা ও সম্পূরক খাদ্য গ্রহণ করলে কিডনির স্বাস্থ্যের উপকার হয়। কিডনিতে কোন সমস্যা থাকলে বা কিডনি রোগের ইতিহাস থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কিডনি সুস্থ রাখতে জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে হবে।

healthline.com, Advanced Urology Institute, Verywell Health, Medical News Today, midtownnephrology.com,