দাদ, চুলকানি, ফাংগাল ইনফেকশনের ঘরোয়া চিকিৎসা। Home Remedies For Fungal Infection:
ছত্রাক বা ফাঙ্গাস আমাদের পরিবেশের সর্বত্র অবস্থান করে, এমনকি আমাদের ত্বকেও বসবাস করে। বেশিরভাগ ছত্রাক আমাদের তেমন কোন ক্ষতি না করলেও, বেশ কিছু ছত্রাক আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করে। দাদ অর্থাৎ রিং-ওয়ার্ম, চুলকানি ইত্যাদি রোগ ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে হতে পারে।
এই প্রতিবেদনে দাদ, চুলকানি ইত্যাদি ফাংগাল ইনফেকশনের ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সবশেষে আলোচনা করা হয়েছে ফাংগাল ইনফেকশনের আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে।
ছত্রাকের সংক্রমণ বা ফাংগাল ইনফেকশন কী? What is a Fungal Infection?
কয়েকটি বিশেষ প্রজাতির আণুবীক্ষণিক ছত্রাক আমাদের দেহের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। টিনিয়া করপোরিস (Tinea corporis) নামক ছত্রাক আমাদের ত্বকে বৃত্তাকার লালচে ফুসকুড়ির মত দাদ রোগ সৃষ্টি করে। টিনিয়া পেডিস (Tinea pedis) নামক ছত্রাক পায়ের আঙ্গুলের মাঝে আক্রমণ করে ক্ষত সৃষ্টি করে, যাকে অ্যাথেলিটস ফিট (Athletes’ Feet) রোগ বলা হয়। টিনিয়া ক্রুরিস (Tinea cruris) আমাদের যৌনাঙ্গের পাশে এবং টিনিয়া ক্যাপিটিস (Tinea capitis) আমাদের মাথার ত্বকে সংক্রমণ ঘটায়। এই ধরনের সংক্রমণ নিজে নিজে সারে না, খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব চুলকায়। সংক্রমিত স্থানটি বিবর্ণ, সাধারণত আঁশযুক্ত দাগ হিসাবে প্রকাশ পায় এবং অনেক সময় ক্ষতস্থান থেকে রস নির্গত হয়। ত্বক ছাড়াও নখ, ঠোঁট, কানের ভিতর ইত্যাদি স্থানে ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে, জীবন যাত্রার মান উন্নত না হলে এই রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। উষ্ণ ও আর্দ্র পরিবেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের এই রোগ বেশি দেখা যায়।
অ্যামাজন থেকে কিনুন Canesten 1% – Tube of 30g Anti-Fungal Cream
ফাংগাল ইনফেকশনের ঘরোয়া চিকিৎসা: Home Remedies For Fungal Infection:
নারকেল তেল: Coconut Oil:
নারকেল তেলের মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবেই ছত্রাক নাশক বৈশিষ্ট্য আছে। নারকেল তেলের মধ্যে ক্যাপ্রাইলিক অ্যাসিড (Caprylic Acid) ও লওরিক অ্যাসিড (Lauric Acid) থাকার কারণে নারকেল তেল ছত্রাক বিরোধী বলে মনে করা হয়।
প্রতিদিন এক থেকে দুই টেবিল চামচ নারকেল তেল খেলে ছত্রাকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। আক্রান্ত স্থানে নারকেল তেল বা নারকেল ও দারচিনি তেল সমপরিমাণ মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। দিনে দুই থেকে তিনবার প্রয়োগ করলে ছত্রাকের সংক্রমণ কমে। যোনিতে ছত্রাকের সংক্রমণ হলে ট্যামপন (Tampon) নামক বিশেষ ধরনের ন্যাপকিনে বেশ কিছুটা নারকেল তেল দিয়ে যোনিতে প্রবেশ করিয়ে দু’ঘণ্টা রাখতে হবে। দু ঘণ্টা পর ট্যামপন (Tampon) বের করে হালকা কুসুম কুসুম গরম জল দিয়ে যোনি পরিষ্কার করতে হবে। দিনে একবার এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
সাবান জল: Soap Water:
দাদ বা অন্যান্য ফাংগাল ইনফেকশন হওয়া অন্যতম কারণ হল অপরিচ্ছন্ন ত্বক। একারণে দাদ হলে যতটা সম্ভব জায়গাটা পরিষ্কার রাখতে হবে ও ত্বক শুকনো রাখতে হবে। দিনে কম করে দুবার আক্রান্ত স্থানটি সাবান জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এবং সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে নিতে হবে। যেকোনো ধরনের ছত্রাক-বিরোধী ওষুধ লাগানোর আগে অবশ্যই ক্ষতস্থানটি পরিষ্কার করতে হবে।
অ্যাপেল সিডার ভিনেগার: Apple Cider Vinegar:
অ্যাপেল সিডার ভিনিগার-এর মধ্যেের মধ্যে ছত্রাক ধ্বংসকারী শক্তি আছে। তাই আক্রান্ত স্থানে অ্যাপেল সিডার ভিনিগার লাগালে দাদ নিরাময় হতে পারে।
অল্প একটু তুলার মধ্যে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার নিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। এই অবস্থায় কম করে এক ঘণ্টা রেখে দেওয়া উচিত। তুলোটি আক্রান্ত স্থানের উপর নিয়ে ঘষাঘষি করলে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিদিন দিনে দুবার দু-চামচ অ্যাপেল সিডার ভিনেগার কুসুম কুসুম গরম জলে মিশিয়ে পান করলেও ছত্রাক নাশক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
রসুন: Garlic:
রসুনের মধ্যে অ্যালিসিন (Allicin) নামক শক্তিশালী অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান থাকে। একারণে দাদ বা ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে রসুন ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রতিদিন দুটি বা তিনটি রসুনের কোয়া খেলে ফাংগাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। রসুন থেঁতো করে তার সাথে কয়েক ফোটা লবঙ্গ তেল মিশিয়ে ক্ষতস্থানে লাগাতে হবে। দিনে দুবার এই লেপ লাগাতে হবে এবং এক ঘণ্টা সময় রেখে দিতে হবে। এরপর ক্ষতস্থানটি হালকা গরম জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। যোনিতে ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে এক টুকরো সিল্কের কাপড়ে রসুন বাটা ও লবঙ্গ গুঁড়ো নিয়ে যোনির ভিতর আধ ঘণ্টা রাখতে হবে। দিনে একবার করে এই চিকিৎসা করলে কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ উপকার মেলে।
চা গাছের তেল: Tea Tree Oil:
অস্ট্রেলিয়ার অদিবাসীরা ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে ও জীবাণুনাশক হিসেবে চা গাছের তেল ব্যবহার করে। ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে চা গাছের তেল বেশ উপকারী হতে পারে।
চা গাছের তেলের সাথে সমপরিমাণ অলিভ অয়েল বা আমান্ড তেল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে বেশ কয়েকবার লাগাতে হবে। একভাগ অ্যালোভেরা জেলের সাথে তিন ভাগ চা গাছের তেল মিশিয়ে ক্ষতস্থানে দিনে দুই থেকে তিনবার লাগালেও উপকার পাওয়া যায়। যোনিতে সংক্রমণ হলে ট্যামপন (Tampon) এর মধ্যে কয়েক চামচ চা গাছের তেল দিয়ে যোনির মধ্যে ট্যামপনটি (Tampon) প্রবেশ করিয়ে দু’ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। দিনে দুই থেকে তিন বার এই চিকিৎসা নিলে উপকার পাওয়া যায়।
হলুদ: Turmeric:
হলুদ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। হলুদের মধ্যে আন্টিফাংগাল ও আন্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য আছে। ছত্রাক ধ্বংস করতেও হলুদ কার্যকরী হতে পারে।
ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে বিভিন্নভাবে হলুদ ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঁচা হলুদের রস বা হলুদ গুঁড়োর সাথে অল্প জল মিশিয়ে লেপ তৈরি করে ক্ষতস্থানের উপর লাগাতে হবে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা রেখে দেওয়ার পর হালকা গরম জল দিয়ে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে ফেলতে হবে। দিনে বেশ কয়েকবার এই চিকিৎসা নিলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া খাদ্যে হলুদ ব্যবহার করলেও উপকার পাওয়া যায়। এক গ্লাস গরম দুধের মধ্যে এক চামচ হলুদ গুঁড়ো ও অল্প একটু মধু মিশিয়ে গরম গরম সেবন করলে ছত্রাকের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হয়।
দই: Curd:
ছত্রাকের সংক্রমণের চিকিৎসা করার জন্য দই-এর ব্যবহার বেশ প্রাচীন। দই-এর মধ্যে ল্যাকটোব্যাসিলাস নামক উপকারী জীবাণু থাকে। এই ল্যাকটোব্যাসিলাস থেকে উৎপন্ন ল্যাকটিক অ্যাসিড ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।
অল্প একটু পরিমাণ তুলোর মধ্যে দই নিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগাতে হবে। 30 মিনিট রেখে দেওয়ার পর হালকা গরম জল দিয়ে ক্ষতস্থানটি ধুয়ে ফেলতে হবে। যোনিতে সংক্রমণ হলে একটি ট্যামপন (Tampon) দই এর মধ্যে ভিজিয়ে যোনিতে প্রবেশ করাতে হবে। যোনির মধ্যে ট্যামপনটি (Tampon) দু’ঘণ্টা রাখা দরকার। এছাড়া প্রতিদিন খাদ্য হিসেবে দই গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়।
ক্যানবেরি জুস: Cranberry Juice:
ক্যানবেরি জুসের মধ্যে অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য আছে। একারণে দাদের চিকিৎসায় ক্যানবেরি জুস ব্যবহার করা যেতে পারে।
দিনে বেশ কয়েকবার ক্যানবেরি জুস পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ক্যানবেরি ট্যাবলেটও কিনতে পাওয়া যায়। দিনে দুই থেকে তিনবার ক্যানবেরি ট্যাবলেট গ্রহণ করলে ছত্রাকের সংক্রমণ কমে।
ফাংগাল ইনফেকশনের আধুনিক চিকিৎসা: Modern Fungal Infection Treatment:
ছত্রাকের সংক্রমণের ঘরোয়া চিকিৎসায় তেমন কোন কাজ না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান খুব সহ সহজেই এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। স্থানীয় ফার্মেসিতে বেশ কিছু অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম ও লোশন কিনতে পাওয়া যায়, যা খুব সহজে ছত্রাকের সংক্রমণ দূর করতে পারে। এই সকল ওষুধ কেনার জন্য সাধারণত প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন হয় না।
ক্লোট্রিমাজোল (Clotrimazole), মাইকোনাজোল (Miconazole), কিটোকোনাজোল (Ketoconazole), টারবিনাফাইন (Terbinafine), ইকোনাজোল (Econazole) ইত্যাদি অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খেতে হবে এবং লাগাতে হবে। ছত্রাকের সংক্রমণ সাধারণত সহজে সারে না, তাই দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়।
তথ্যসূত্র:
Pharmeasy.in, Cleveland Clinic, Mediciver Hospital, Healthlinr.com etc.