Healthy Lifestyle স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাখাদ্য ও পানীয় Food & Drinksস্বাস্থ্যকর চুল Healthy Hair

দুধ পান করার সময় আমরা যে 6টি ভুল করি: দুধ পান করার সঠিক নিয়ম: 6 Common Mistake People Do While Drinking Milk and Their Solution:

দুধ হল ক্যালসিয়াম, ভিটামিন D এবং প্রোটিনের মত পুষ্টি উপাদানের দারুণ উৎস। দুধ আমাদের হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দুধ পানের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রায় 6000 বছর আগে মধ্য নিওলিথিক যুগ থেকে আমরা দুধ পান করে আসছি। তবে সবার ক্ষেত্রে গরুর দুধ আদর্শ নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুধ পান করার ফলে হজমের সমস্যা, অ্যালার্জি ইত্যাদি জটিলতা দেখা যায়। এই সমস্যাগুলির প্রধান কারণ হল সঠিক নিয়ম মেনে দুধ না খাওয়া। দুধ পান করার সময় আমরা যে 6টি ভুল করি, সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল এই প্রতিবেদনে। এছাড়া দুধ পান করার সঠিক নিয়ম নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। যাদের ল্যাক্টোজ ইনটলারেন্সের সমস্যা আছে, তারা কিভাবে এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন সেটাও জেনে নেব।

দুধকে সুষম খাদ্য বলা হয় কারণ; দুধের মধ্যে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার পুষ্টি উপাদান থাকে। দুধ শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দুধে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি থাকার সাথে সাথে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদি খনিজ উপাদান থাকে। এছাড়া দুধের মধ্যে থাকে ভিটামিন A, ভিটামিন D, ভিটামিন B12, ভিটামিন C ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান। অর্থাৎ দুধ ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের একটি দারুণ উৎস।

দুধ প্রোটিনের চমৎকার একটি উৎস। বেশ কয়েক প্রকার ফাটি অ্যাসিড যেমন কনজুগেটেড লিনোলিক(CLA) অ্যাসিড, ওমেগা 3 ইত্যাদি দুধে উপস্থিত থাকে। যেসব গরু বেশি পরিমাণ সবুজ ঘাস খায় তাদের দুধে ভিটামিন E ও বিটা-ক্যারোটিনের মত উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশি পরিমাণে থাকে।

আমাদের দেশে সাধারণত ঠাণ্ডা দুধ পান করার প্রথা নেই। তবে বিদেশে বিশেষ করে ইউরোপ বা আমেরিকাতে ঠাণ্ডা দুধ পান হল প্রচলিত পদ্ধতি। আমাদের দেশে দুধ মানেই গরম। ঠাণ্ডা দুধ পান সাধারণত স্বাস্থ্যকর বলেই মনে করা হয়। কিন্তু সবার জন্য এটি উপযুক্ত নাও হতে পারে। ঠাণ্ডা দুধ পান করলে পেটে বদহজম, পেট ব্যথা, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ভারী খাবারের পর ঠাণ্ডা দুধ পান করলে পৌষ্টিকতন্ত্রে চাপ পড়ে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।

আমাদের কাছে গরম দুধ পান বেশ ভাল একটা অনুভূতি দেয়। গরম দুধ হজম করা বেশি সহজ। গরম দুধ পাতলা পায়খানা ও বদ হজমের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। গরম দুধে থাকে ট্রিপটোফ্যান নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা আমাদের ঘুমোতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, শোয়ার আগে গরম দুধ খেলে ঘুম ভাল হয়। এছাড়া গরম দুধ শরীরের প্রদাহ ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। দুধের সাথে প্রোটিন পাউডার গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই দুধ গরম করতে হবে।

খাবারের সাথে দুধ পান করার ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত আছে। দুপুর বা রাত্রের খাবারের সাথে দুধ পান করলে পাচনতন্ত্রের উপর বেশি চাপ পড়ে। তাই খাবার খাওয়ার সাথে সাথে দুধ পান না করে, এক থেকে দু-ঘণ্টা ব্যবধান রাখলে হজমে সমস্যা হয় না। তবে দুগ্ধজাত পণ্য যেমন দই খাওয়া যেতে পারে; কারণ দই-এর মধ্যে উপকারী জীবাণু অর্থাৎ প্রোবায়োটিক থাকে।

ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদির সাথে দুধ খাওয়া উচিত নয়। এই সকল উচ্চ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য একসাথে খেলে পাচনতন্ত্রে চাপ পড়ে ও বদহজম হতে পারে। আয়ুর্বেদ দুধ এবং মাংস একসাথে না খাওয়ার কথা বলেছে; কারণ এর ফলে শরীরের কার্যকলাপের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে ও ত্বকে অ্যালার্জি হতে পারে।

সকালের জলখাবারের সাথে দুধ অবশ্যই খাওয়া যেতে পারে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, জলখাবারে দুধের সাথে ওটস ইত্যাদি গ্রহণ  করলে খুব সহজে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায়।

আমরা অনেকেই দুধে চিনি মিশিয়ে খেতে পছন্দ করি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দুধের সাথে চিনি মেশানো মোটেই ভাল বলে মনে করেন না। চিনি মেশানো দুধ পান করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এভাবে দুধ খেলে বদহজম, অ্যাসিডিটি, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দুধে চিনি মেশালে ওজন বেড়ে যেতে পারে, ডায়াবেটিসের জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। চিনি ও দুধে থাকা চর্বি একসাথে লিভারে চর্বি জমা করে ফ্যাটি লিভার রোগের সূচনা করতে পারে।

দুধ খাওয়ার জন্য চিনির প্রয়োজন নেই বললেই চলে। দুধের মধ্যে ল্যাকটোজ নামক শর্করা থাকার কারণে দুধের মধ্যে হালকা মিষ্টতা আছে। কয়েকদিন চিনি ছাড়া দুধ খাওয়ার অভ্যাস করলে, দুধের নিজস্ব মিষ্টতা অনুভব করা সম্ভব হয়। তখন চিনি ছাড়া দুধ খেতেই বেশি ভাল লাগে।

দুধের সাথে ফল খাবেন কি খাবেন না, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে বলেন ফল খাওয়া যেতে পারে, আবার অনেকে বলেন খাওয়া উচিত নয়। তবে এব্যাপারে আপনার নিজের শরীরের কথা শোনা উচিত। আয়ুর্বেদ অনুসারে বলা যায় যে, বেরি জাতীয় ফল যেমন স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, জাম ইত্যাদি ফল দুধের সাথে খাওয়া চলবে না।

আম, কলা, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি মিষ্টি ফল দুধের সাথে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া শুকনো ফল যেমন কিসমিস, আমন্ড, খেজুর ইত্যাদিও গ্রহণ করা যেতে পারে। কিশমিশ রক্ত উৎপাদনে সাহায্য করে এবং খেজুর দেহে আয়রনের পরিমাণ বাড়ায়, ফলে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি পায়। তবে ফল ও দুধ একসাথে খাওয়ার পর বদহজম হলে বা অস্বস্তি হলে, ফল ও দুধ একসাথে খাওয়া চলবে না।

আমরা অনেকেই জল খাবার খাওয়ার পর দুধ খেয়ে থাকি। জলখাবারে নোনতা খাবার খেলেও দুধ খেয়ে থাকি। কিন্তু আয়ুর্বেদ বলছে যে, নোনতা খাদ্যের সাথে দুধ খাওয়া একেবারেই চলবে না। এর ফলে দুধের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় ও স্বাস্থ্য নষ্ট হতে পারে। দুধের সাথে লবণ মিশিয়ে খেলে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে।

দুধের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে, যার নাম ক্যালসিয়াম ক্যাসিনেট। এই ক্যালসিয়াম ক্যাসিনেট আমাদের পাকস্থলীতে উপস্থিত অ্যাসিডের সাথে বিক্রিয়া করে ভেঙে যায়, ফলে দুধের হজম সহজ হয়। দুধে লবণ মেশালে এই পদ্ধতি বাধা পায় ও হজমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি হতে পারে। তবে দই-এর সাথে লবণ খেলে তেমন কোন ক্ষতি হয় না। এছাড়া নোনতা খাবার খাওয়ার 35 থেকে 50 মিনিট পর দুধ খাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রেও তেমন কোনও সমস্যা হয় না।

দুধে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি উপাদান আছে বলে অতিরিক্ত পরিমাণ দুধ খাওয়া মোটেই ভালো নয়। কম বয়সী বালক বালিকাদের দিনে মোট 480 মিলিলিটার এর বেশি দুধ খাওয়ানো উচিত নয়। বেশি দুধ খেলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। দুধে প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকার কারণে এটা হতে পারে।

প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দিনে দু’কাপ অর্থাৎ 480 ml এর বেশি দুধ খাওয়া উচিত নয়। বেশি দুধ খেলে হার্টের রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। দুধে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, ফলে বেশি দুধ খেলে অন্ত্রে আয়রনের শোষণ বাধা পায় ও অ্যানিমিয়া হতে পারে। এছাড়া বেশি দুধ খেলে প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম বেশি নির্গত হয় ও হাড় দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে সহজে ভেঙে যেতে পারে।

দুধ খাওয়ার সঠিক সময় আপনার ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভরশীল। শোয়ার আগে দুধ খাওয়া বেশ ভাল। দুধে ট্রিপটোফ্যান আছে, এটি একটি অ্যামাইনো অ্যাসিড যা মেলাটোনিন তৈরিতে সাহায্য করে। এই মেলাটোনিন আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। শোয়ার আগে দুধ খেলে আমাদের ঘুম ভাল হয়। এছাড়া বিছানায় যাওয়ার আগে দুধ খেলে আমাদের ত্বক উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে।

সকালে দুধ খাওয়া যেতে পারে। এটা বাড়ন্ত শিশুদের জন্য বেশ ভাল। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরাও সকালে দুধ খেতে পারেন। এর ফলে দেহে শক্তির অভাব হয় না ও ওজন বাড়ে। এছাড়া দিনের যেকোন সময় দুধ খাওয়া যেতে পারে।

দুধ খেতে চাইলে প্রথমে সঠিক দুধ নির্বাচন করতে হবে। বাজারে বিভিন্ন প্রকার দুধ পাওয়া যায়। মাখন সহ বা মাখন তোলা দুধ পাওয়া যায়। এছাড়া সরাসরি গোয়ালাদের কাছ থেকেও দুধ সংগ্রহ করা যেতে পারে। ভেজালমুক্ত দুধ পান করার জন্য সচেতন থাকা দরকার। মাখন তোলা প্যাকেট-জাত দুধের মধ্যে ফ্যাট কম থাকে। এছাড়া মাখন তোলা প্যাকেট-জাত দুধে সয়াবিনের গুঁড়ো ও বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন আলাদাভাবে যোগ করা থাকে।

শিশুদের জন্য মাখনসহ সম্পূর্ণ দুধ পান করা বেশি ভাল। তবে অ্যালার্জির সমস্যা হলে দুধ পান করা চলবে না। এক বছরের কম বয়সী শিশুদের গরুর দুধ খাওয়ানো নিষেধ। কারণ এক্ষেত্রে তীব্র অ্যালার্জি-জনিত ঠাণ্ডা লাগার সমস্যা হতে পারে। দুধে অ্যলার্জি থাকলে শিশুদের গরুর দুধের বদলে মহিষের দুধ খাওয়ানো যেতে পারে।

প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের তেমন কোন শারীরিক জটিলতা না থাকলে মাখন যুক্ত দুধ খাওয়া যেতে পারে। তবে ওজন কমাতে চাইলে বা কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে মাখন তোলা দুধ খেতে হবে।

আয়ুর্বেদে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করার জন্য ঔষধি যুক্ত দুধ খেতে বলা হয়। দুধের মধ্যে অল্প পরিমাণে হলুদ গুঁড় মিশিয়ে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দুধ গরম করার সময় এক চিমটি হলুদ, এক চিমটি গোল মরিচ ও এক টুকরো দারচিনি যোগ কর যেতে পারে। এর ফলে দুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সমস্যা কমে।

দুধের মধ্যে ল্যাকটোজ নামক শর্করা থাকে। যে সকল ব্যক্তির এই ল্যাকটোজ শর্করা হজমে সমস্যা হয়, তাদের ল্যাকটোজ অ-সহিষ্ণু বলা হয়। প্রতি 10 জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে 1 জন ল্যাকটোজ অ-সহিষ্ণু। ল্যাকটোজ অ-সহিষ্ণু ব্যক্তিরা দুধ পান করলে বদহজম, গ্যাস, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

ল্যাকটোজ অ-সহিষ্ণু ব্যক্তিরা দুধ পান করতে চাইলে দুধ গরম করার সময় এক কাপ দুধে এক টুকরো আদা যোগ করতে হবে। আদা মেশানো দুধ 10 মিনিট ফোটানোর পর অল্প অল্প পরিমাণ পান করতে হবে। প্রথমে কিছুদিন অল্প পরিমাণ দুধ পান করে অভ্যাস হয়ে গেলে, পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। এছাড়া বাজারে ল্যাকটোজ মুক্ত দুধ পাওয়া যায়। এই দুধ পান করলে তেমন কোন সমস্যা ছাড়াই দুধের পুষ্টি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।

My tour, Times of India, Health Shots, Britanica