পায়খানায় রক্ত পড়ার কারণ ও প্রতিকার। Blood In Stool: Causes & Treatment:
মলের মধ্যে রক্ত দেখলে আমরা সকলেই ভয় পেয়ে যায়। কী কারণে মলে রক্ত পড়ে এটা সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে প্রথমেই এত চিন্তার কিছু নেই, কারণ এই ধরনের সমস্যা খুব সহজেই নিরাময় যোগ্য। এই প্রতিবেদনে পায়খানায় রক্ত পড়ার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হল।
পৌষ্টিকতন্ত্রে অর্থাৎ গ্যাস্ট্রোইনটেসটাইনাল ট্রাক্টে আঘাত লাগলে, প্রদাহ সৃষ্টি হলে বা আলসার হলে রক্তপাত হতে পারে। পায়খানায় রক্ত পড়ার কারণগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল।
পায়খানায় রক্ত পড়ার কারণ: Causes of Blood in Stool:
গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস: Gastroenteritis:
পাকস্থলী এবং অন্ত্রকে প্রভাবিত করে এমন ভাইরাল, পরজীবী বা ছত্রাকের সংক্রমণকে গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস বলা হয়। এক্ষেত্রে রোগ লক্ষণগুলি প্রায় 14 দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কী কারণে সংক্রমণ তার উপর রোগ লক্ষণ নির্ভর করে। পেটব্যথা, বমি, বমি বমি ভাব, রক্তযুক্ত ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, জ্বর, পেশিতে ব্যথা ইত্যাদি রোগলক্ষণ দেখা যায়। দূষিত খাবার, পচা খাবার, দূষিত জল ইত্যাদি থেকে সংক্রমণ ঘটে। অপরিষ্কার হাত থেকেও এই সংক্রমণ হতে পারে।
হেমোরয়েডস ও অ্যানাল ফিসার: Hemorrhoids and Anal Fissures:
মলদ্বার থেকে রক্তপাত হওয়ার অন্যতম কারণ হল হেমোরয়েড। মলদ্বারের রক্তনালী ফুলে যাওয়া ও সেখান থেকে রক্তপাত হওয়া কে হেমোরয়েড বা অর্শ্ব বলে। এছাড়া মলদ্বারের অন্য আর একটি রোগ হল ফিসার। এক্ষেত্রে মলদ্বারের ত্বক ফেটে গিয়ে বা ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাত হয়। মলদ্বারের রোগে মলদ্বার চুলকায়, মলদ্বারে ব্যথা হয় এবং অস্বস্তি হয়। রক্তপাত হলে তাজা রক্ত দেখা যায় এবং রক্ত মলের মধ্যে মিশে থাকে না।
ডাইভার্টিকুলোসিস: Diverticulosis:
অন্ত্র ও মলাশয়ের দেওয়ালে ছোট ছোট থলি সৃষ্টি হতে পারে যাদের ডাইভার্টিকুলা বলা হয়। এই ডাইভার্টিকুলাগুলির মধ্যে ইনফেকশন হলে ফুলে ওঠে ও রক্তপাত হতে পারে। এক্ষেত্রে মলের রং মেরুন বা লালচে হয়। মলের মধ্যে তাজা রক্ত দেখা যায় না; রক্ত মলে মিশে যায়।
পেপটিক আলসার: Peptic Ulcers:
পাকস্থলী ও ডিওডিনামের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি হলে তাকে পেপটিক আলসার বলা হয়। হেলিকোব্যাকটর পাইলোরি নামক জীবাণুর সংক্রমণ হলে বা টানা হাইপার অ্যাসিডিটি, বদহজম ইত্যাদির সমস্যা থাকলে আলসার হতে পারে। পেপটিক আলসার থেকে রক্তপাত হতে পারে ও মলে রক্ত মিশে মলের রং কালো হতে পারে। এই রোগে পেট ফোলা, পেট ব্যথা, বমি, বমি বমি ভাব, ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া ইত্যাদি রোগলক্ষণ দেখা যায়।
ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ: Inflammatory Bowel Disease:
পেটের মধ্যে প্রদাহ সৃষ্টি হলে মলে রক্ত পড়তে পারে। ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ হলে পেট ব্যথা, ডায়রিয়া, ওজন কমে যাওয়া, ক্লান্তি ইত্যাদি রোগলক্ষণ দেখা যায়। এই রোগের প্রকৃত কারণ এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তবে বংশগত কারণে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সমস্যা জনিত কারণে এই রোগের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজ প্রধানত দুই প্রকার, আলসারেটিভ কোলাইটিস এবং ক্রোনস ডিজিজ।
ঔষধ: Medication:
বিভিন্ন কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনে রক্ত পাতলা করার ঔষধ সেবন করার প্রয়োজন পড়ে। রক্ত পাতলা করার ঔষধ খাওয়ার কারণে অনেক সময় পৌষ্টিক নালীতে রক্তপাত হতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কারণ এটি একটি জরুরি অবস্থা।
পলিপ ও কোলোন ক্যান্সার: Polyps and Colon Cancer:
পলিপ হল একপ্রকার টিউমার জাতীয় বৃদ্ধি যা কোলোন বা মলাশয়ের ত্বকে হতে পারে। কিছু পলিপ সময়ের সাথে সাথে ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে; বিশেষ করে যদি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করা না হয়। পলিপ ও ক্যান্সার উভয় ক্ষেত্রেই মলদ্বারে রক্তপাত হতে পারে এবং মলের মধ্যে রক্ত দেখা যায়।
পায়খানায় রক্ত পড়া রোগ নির্ণয়: Diagnosis of Blood in Stool:
মলে রক্ত পড়ার কারণ নির্ণয় করার জন্য প্রথমে রোগের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নেওয়া হয়। আপনার চিকিৎসক এবিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করবেন। কী কী ওষুধ সেবন করেন, খাদ্যাভ্যাস কেমন, জীবনযাত্রা কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে জানবেন। এছাড়া আপনার চিকিৎসক বেশ কিছু শারীরিক পরীক্ষা করবেন; মলদ্বার পরীক্ষা করে দেখবেন।
মলে রক্তের উপস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মলের রুটিন টেস্ট ও অকাল ব্লাড টেস্ট করতে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে কোলোনোসস্কোপি বা এন্ডোসস্কোপি করতে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার সাহায্যে রক্তপাতের কারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া পৌষ্টিকতন্ত্রের আশেপাশের বিভিন্ন অঙ্গগুলির সম্পর্কে ধারণা পেতে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা এম. আর. আই করার দরকার হতে পারে।
পায়খানায় রক্ত পড়ার চিকিৎসা: Treatment for Blood in Stool:
কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো কোনো কারণে রক্তপাত হলে নিজে নিজেই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায়; তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। তবে অন্য কোনো জটিল রোগের কারণে রক্তপাত হলে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। ভাইরাস, পরজীবী বা ছত্রাকের সংক্রমণের কারণে বা ইনফ্লামেটরি বাওয়েল ডিজিজের কারণে রক্তপাত হলে অবশ্যই নিয়ম মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, প্রদাহ বিরোধী ওষুধ ইত্যাদি সেবন করতে হবে। হেমোরয়েড ও ফিসার হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খেতে হবে, প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এছাড়া ডাইভার্টিকুলোসিস বা পেপটিক আলসার হলে চিকিৎসা করাতে হবে। রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেয়ে রক্তপাত হলে ওষুধ বন্ধ করে চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। পলিপ বা কোলোন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো হাসপাতালে যোগাযোগ করুন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করান।
চিকিৎসা করার সাথে সাথে জীবনযাত্রা পরিবর্তনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন ও প্রতিদিন শরীরচর্চা করুন। উচ্চ ফাইবার-যুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করলে এই সমস্যার জটিলতা অনেকটা কমে।
মলে রক্ত পড়া উদ্বেগ জনক নাও হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করা ভালো। রক্তপাতের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্যই করা দরকার। যদি প্রচুর পরিমাণ রক্তপাত হয়, রক্ত জমাট বাঁধে অথবা যদি মাথা ঘোরে বা অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ থাকে, সেক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে।
তথ্যসূত্র:
WebMD, MedicalNewsToday, Verywell Health, Care Hospital e.t.c.