পেঁপে কোন কোন রোগে খুব বেশি উপকারী? কাদের ভুলেও পেঁপে খাওয়া উচিত নয়? Scientifically Proven Health Benefits of Papaya:
পেঁপে একটি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিগুণে ভরপুর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল। ভারতীয় আয়ুর্বেদে পেঁপের কোন উল্লেখ নেই, কারণ এটি আসলে আমেরিকা মহাদেশ থেকে ভারতে এসেছে। পেঁপে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল এবং পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ উপাদান আছে। পেঁপেতে থাকা বেশ কিছু জৈব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে পারে। পেঁপে কোন কোন রোগে খুব বেশি উপকারী সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। কাদের ভুলেও পেঁপে খাওয়া উচিত নয় সেটা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
পেঁপেতে উপস্থিত প্রধান প্রধান জৈব রাসায়নিক উপাদান: Major Bioactive Constituents of Papaya:
আমেরিকার আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস পেঁপেকে দেবদূতদের ফল বলে অভিহিত করেছিলেন। পেঁপের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি উপাদান যেমন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন যেমন ভিটামিন A, ভিটামিন C, ভিটামিন B ইত্যাদি উপস্থিত থাকে। এছাড়া পেঁপেতে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ উপাদান থাকে। পেঁপেতে ক্যারোটিনয়েড (Carotenoids) থাকে যা একটি স্বাস্থ্যকর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পেঁপেতে প্যাপেন নামক উৎসেচক থাকে যা মাংস হজম করতে সাহায্য করে ও আমাদের হজম শক্তির উন্নতি ঘটায়। প্যাপেন প্রদাহ বিরোধী হওয়ার কারণে ক্ষত নিরাময়ে ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। প্যাপেন ছাড়াও পেঁপেতে থাকে কাইমোপ্যাপেন(Chymopapain) যা প্রোটিন হজম করতে সাহায্য করে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। ফ্ল্যাভোনয়েড ও অ্যান্থোসায়ানিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে পেঁপেতে, যা অক্সিডেটিভ ট্রেস কমায়, ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পেঁপেতে থাকে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার। ফাইবার অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে ও অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
পেঁপের উপকারিতা: Health Benefits of Papaya:
দৃষ্টিশক্তি ও চোখের স্বাস্থ্য: Vision and Eye Health:
পেঁপেতে উপস্থিত কিছু জৈব রাসায়নিক যৌগ ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের কারণে হওয়া চোখের প্রদাহ কমায়। চোখে রেটিনার স্বাস্থ্য রক্ষা করতে লাইকোপিন(Lycopene) নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বেশ ভালো কাজ করে। ক্যারোটিনয়েড যৌগগুলি রাতকানা রোগ দূর করে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পরিবেশের ব্লু আলো থেকে চোখকে রক্ষা করে।
অ্যাসমা বা হাঁপানি: Asthma:
প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও ফল খেলে হাঁপানের ঝুঁকি কমে এবং হাঁপানির সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। শাকসবজি ও ফলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার ও ভিটামিন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত করে, ফলে হাঁপানির সমস্যা কমে। 2022 সালের একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্যারোটিন, লাইকোপিন ও জেক্সানথিন(Zeaxanthin) বেশি গ্রহণ করলে হাঁপানির সমস্যা কমে। পেঁপের মধ্যে এই তিনটি উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকার কারণে পেঁপে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া পেঁপে পাতার নির্যাস গ্রহণ করলে ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।
ক্যান্সার: Cancer:
পেঁপেতে উপস্থিত লাইকোপিন, জেক্সানথিন এবং লুটিন (Lycopene, Zeaxanthin, Lutin) ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা নেয়। বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, লাইকোপিনের মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য আছে, বিশেষ করে প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটি বেশ কার্যকর। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে জেক্সানথিন গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার কোষের উপর প্রভাব ফেলে এবং লুটিন স্তন ক্যান্সারের বৃদ্ধি রোধ করে। পেঁপেতে থাকা আন্টিঅক্সিডেন্টগুলি কোষের DNA-এর ক্ষতি রোধ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশন করতে এবং লিভার ডিটক্স করতে পেঁপে বেশ উপকারী।
পরিপাক: Digestion:
পেঁপের সবচেয়ে বিখ্যাত বৈশিষ্ট্য হল হজম অর্থাৎ পরিপাকে সাহায্য করা। কাঁচা পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ প্যাপেন থাকে যা প্রোটিন হজম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আর একারণে মাংস জাতীয় খাদ্য সহজে পরিপাক করার জন্য রান্নায় পেঁপে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকার কারণে অন্ত্রের পরিবেশ ভালো থাকে ফলে পেটের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ও ইরিট্যাবল বাউল সিনড্রোমের সমস্যা কমাতে পেঁপে কার্যকরী হতে পারে। পেঁপের বীজ, পাতা, শিকড় ইত্যাদি আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
হৃদরোগ: Heart Disease:
পেঁপেতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন লাইকোপিন, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। পেঁপেতে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং ধমনীতে প্লাক জমতে বাধা দিয়ে হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। পেঁপেতে পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকার কারণে পেঁপে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পটাশিয়াম বেশি গ্রহণ করলে ও সোডিয়াম কম গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
হাড়ের স্বাস্থ্য: Bone Health:
ভিটামিন K এর অন্যতম ভালো উৎস হল পেঁপে। ভিটামিন K-এর অভাব হলে হার দুর্বল হয়ে যেতে পারে। পেঁপে গ্রহণ করলে ভিটামিন K-এর অভাব মেটে ও হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। পর্যাপ্ত ভিটামিন K গ্রহণ করলে অন্ত্রের ক্যালসিয়ামের শোষণ বৃদ্ধি পায় ও প্রস্রাবে ক্যালসিয়ামের নির্গমন কমে, ফলে হাড় শক্তিশালী হয়।
ত্বকের স্বাস্থ্য: Skin Health:
ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পেঁপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। পেঁপেতে থাকা ভিটামিন A, ভিটামিন C ও ভিটামিন E ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে। গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে পেঁপে খেলে ত্বকের প্রদাহ কমে ও ত্বকে লাল ভাব কম দেখা যায়। এছাড়া পেঁপেতে থাকা জৈব রাসায়নিকগুলি ত্বকের বলিরেখা কমিয়ে বার্ধক্যজনিত ত্বকের ক্ষতি প্রতিরোধ করে। ফলে ত্বক তরুণ ও উজ্জ্বল থাকে। একারণে বিভিন্ন প্রসাধনীতে পেঁপের নির্যাস ব্যবহার করা হয়।
রোগ প্রতিরোধ: Immunity:
পেঁপেতে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যেমন ভিটামিন C, বিটাকারোটিন এবং ফ্ল্যাভোনয়েড। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি শরীরে ফ্রী রাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে ও অক্সিডেটিভ ট্রেস কমায়। এরফলে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের মতো কিছু জটিল রোগের ঝুঁকি কমে। নিয়মিত পেঁপে খেলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও শরীর সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায়। পেঁপের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী প্রভাবের জন্য অসুস্থতা থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়।
কাদের পেঁপে খাওয়া উচিত নয়? Who Should Avoid Eating Papaya?
পেঁপের অসাধারণ উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পেঁপে খাওয়া বিপদজনক হতে পারে।
পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন একটি শক্তিশালী অ্যালার্জেন, তাই অতিরিক্ত পেঁপে খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই যাদের অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাদের পেঁপে খাওয়া চলবে না বা কম খেতে হবে।
পেঁপেতে ফাইবার থাকার কারণে পেঁপে হজমের সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত পেঁপে খেলে ডায়রিয়া, ডিহাইড্রেশন ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কাঁচা বা আংশিক পাকা পেঁপে খেলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের পেঁপে খাওয়া কঠোরভাবে নিষেধ।
অনেক সময় পেঁপে পৌষ্টিকতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যাদের পেটের সমস্যা আছে এবং যাদের পেঁপে খেলে পেটের সমস্যা বৃদ্ধি পায়, তাদের পেঁপে কম খাওয়া উচিত।
যে সকল ব্যক্তিদের কিডনিতে স্টোন আছে, যারা হার্টের রোগে ভুগছেন, যাদের হাইপোথাইরয়েডের সমস্যা আছে, তাদের পেঁপে কম খাওয়া উচিত।