পেটের চর্বি কমানোর 7টি উপায়। 7 Fastest Ways to Lose Belly Fat.
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে এবং পেটের চর্বি কমাতে পারলে আমরা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকি। পেটের চর্বি কমানোর সর্বোত্তম উপায় হল স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা। বেশ কিছু ওষুধ বা পরিপূরক খাদ্য নির্মাতারা দাবি করেন যে, তাদের পণ্যগুলি দ্রুত ওজন কমাতে পারে ও পেটের চর্বি দূর করতে পারে। কিন্তু এই পণ্যগুলি আদেও নিরাপদ বা কার্যকর কিনা সেটা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ প্রমাণের অভাব আছে। এই প্রতিবেদনে পেটের চর্বি কমানোর 7 টি উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
পেটের চর্বি কী? What is belly fat?
চর্বি মানেই খারাপ, এটা ভাবা ঠিক নয়। চর্বি আমাদের শরীরকে আঘাতের হাত থেকে রক্ষা করে, শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে এবং হরমোনের উৎপাদন ও কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরে কিছু পরিমাণ চর্বি থাকা অত্যাবশ্যক ও স্বাস্থ্যকর।
পেটে প্রধানত দুই প্রকার চর্বি থাকে। আমাদের ত্বকের ঠিক নিচে থাকে সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট বা চর্বি। সারা দেহে ত্বকের নিচে এই চর্বি থাকে এবং পেটের মধ্যেও এই চর্বি থাকে। এছাড়া পেটের মধ্যে থাকে অন্য এক ধরনের চর্বি, যাকে ভিসারাল ফ্যাট বলা হয়। এই চর্বি আমাদের দেহের গভীরে অবস্থিত এবং এই চর্বি আমাদের পেটের বিভিন্ন অঙ্গগুলিকে ধারণ করে ও আঘাত থেকে রক্ষা।
ভিসারাল ফ্যাট ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগের সম্ভাবনা বাড়ায়। যাদের ভিসারাল ফ্যাট বেশি থাকে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পেটে চর্বি বেশি থাকলে রক্তে বেশি পরিমাণ প্রদাহজনক সাইটোকাইন নি:সৃত হতে পারে, ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একটি ছোট্ট আঘাতের ফলে রক্ত জমাট বাধার সম্ভাবনা থাকে ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পেটের চর্বি কমানোর উপায়: Ways to Lose Belly Fat:
শরীরের নির্দিষ্ট কোন অংশ থেকে চর্বি কমানো সহজে সম্ভব হয় না, তবে এমন কিছু কৌশল আছে যার সাহায্যে সারা দেহ থেকে চর্বি কমানো সম্ভব। একইভাবে এই কৌশলগুলি পেটের চর্বি কমাতে ব্যবহার করা যায়।
রাত্রে ভাজা খাবার না খাওয়া: Banish Midnight Snacking:
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আমাদের শরীরের ঘড়ি ও প্রাকৃতিক ছন্দ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করা স্বাস্থ্যকর। এর ফলে খাদ্য হজম করা সহজ হয় ও খাদ্যের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করা সম্ভব হয়। সকালের দিকে ভারি খাদ্য গ্রহণ করলে সহজে হজম হয় ও খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণ ভাল হয়। এর ফলে আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে ও দেহে চর্বির পরিমাণ কমে। অধিক তেল ও চর্বিযুক্ত ভাজা খাদ্য অর্থাৎ স্ন্যাকস জাতীয় খাদ্য সূর্যাস্তের পর গ্রহণ করলে দেহে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পেটের চর্বিও বাড়ে। তাই পেটের চর্বি কমাতে রাত্রে খাবারের সাথে বা খাওয়ার পর ভাজাভুজি পরিত্যাগ করা দরকার। আমরা অনেক রাত্রে লুচি, পরোটা ও অন্যান্য ভাজা খাবার খেয়ে থাকি। আয়ুর্বেদের মতে এটা মোটেই ভাল অভ্যাস নয়।
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের সঠিক নির্বাচন: Carefully Consider Your Carbs:
পেটে চর্বি জমার জন্য প্রধানত ফ্যাট জাতীয় খাদ্যকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু দেহে চর্বি জমার ক্ষেত্রে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্যের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার অত্যধিক ব্যবহারের ফলে পেটে চর্বি জমে। শুধুমাত্র কম চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে এই সমস্যা মিটবে না। তাই পেটের চর্বি কমাতে হলে অবশ্যই কী ধরনের কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করছেন সেটার দিকে নজর দিতে হবে। খাবার কম খাওয়ার দরকার নেই, শুধুমাত্র গুণগত মানোন্নয়ন করতে হবে। ফলের জুস, কুকিস, আলু, গমের রুটি, ভাত ইত্যাদির পরিমাণ কমানো ভাল। পরিবর্তে শাকসবজি, মটরশুঁটি, শিম, গোটা শস্য ইত্যাদি ফাইবার যুক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণ: Consume foods rich in fiber:
ফাইবার হল এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের শরীর হজম করতে পারেনা। এটি আমাদের পৌষ্টিকতন্ত্রের কাজ স্বাভাবিক রাখে ও হজমে সাহায্য করে। ফাইবার-যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে পেট ভরে থাকার অনুভূতি হয় ও মন তৃপ্তি পায়। পর্যাপ্ত ফাইবার-যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে রক্তে শর্করা অর্থাৎ সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া এটি ক্ষুধার অনুভূতি কম করে, ফলে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা কমে।
পেটের চর্বি কমানোর চেষ্টা করলে ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন মসুর ডাল, মটরশুঁটি, ব্রকলি, শাকসবজি ইত্যাদি বেশি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া আপেল, নাশপাতি, বাদাম, ছোলা ইত্যাদি গ্রহণ করা দরকার।
অধিক হাঁটা: Walk More:
প্রতিদিন অবশ্যই হাঁটাহাঁটি করা দরকার। হাঁটলে আমাদের শরীর সুস্থ থাকে ও মন ভাল থাকে। প্রতিদিন 10,000 পা অর্থাৎ প্রায় 8 কিলোমিটার হাঁটা সবথেকে ভাল। কিন্তু এতটা হাঁটা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই কম করে 2500 পা অর্থাৎ প্রায় 2 কিলোমিটার অবশ্যই হাঁটতে হবে। এটা আমাদের দেহের চর্বি কমাতে যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে। জার্নাল অফ এক্সারসাইজ নিউট্রিশন অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, নিয়মিত হাঁটলে পেটের চর্বি ও সামগ্রিক শরীরের চর্বি হ্রাস পায়। যেকোন সময় হাঁটতে পারেন, যখনই সময় পাবেন হাঁটতে পারেন। আয়ুর্বেদের মতে সকাল বেলায় ব্যায়াম ও প্রাণায়াম করা উচিত ও বিকেলে হাঁটা উচিত।
পেটের চর্বি কমানোর আর একটি কার্যকর উপায় হল ব্যায়াম। বিশেষ কিছু ধরনের পেটের ব্যায়াম চর্বি কমাতে বেশ ভাল কাজ করে। এছাড়া দৌড়ানো, খেলাধুলা, সাইকেল চালানো সাঁতার ইত্যাদিও পেটের চর্বি কমাতে পারে।
পর্যাপ্ত ঘুম: Enough Sleep:
বর্তমানের ব্যস্ত জীবনে আমরা পর্যাপ্ত ঘুম বা বিশ্রামের সময় পায়না। ঘুমের অভাব আমাদের স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যারা প্রতি রাতে 7 ঘন্টার কম ঘুমায় তাদের মধ্যে স্থূলতার সমস্যা বেশি দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের সাধারণত রাত্রে কমপক্ষে 7 ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে আরও একটু বেশি ঘুমের দরকার হয়। এছাড়া ঘুমের মানও গুরুত্বপূর্ণ। গভীর ঘুম আমাদের ক্লান্তি দূর। ঘুমের বিঘ্ন ঘটা মোটেই ভাল নয়। একারণে একটি আরামদায়ক পরিবেশে ভাল ঘুমের প্রয়োজন। ঘুম ভাল হলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে ও দেহে চর্বির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
দুশ্চিন্তা কমানো: Reduce Stress:
মানসিক চাপে ভোগা ব্যক্তিদের পেটের চারপাশে চর্বির পরিমাণ বাড়তে পারে। উচ্চ-চর্বিযুক্ত, উচ্চ চিনিযুক্ত বা উচ্চ ক্যালরি-যুক্ত খাবার খেলে পেটের চর্বি বাড়তে পারে। তবে এইগুলিই একমাত্র কারণ নয়। মানসিক চাপে ভুগতে থাকলে দেহে কর্টিসোল হরমোনের পরিমাণ বাড়ে ও দেহে চর্বির পরিমাণ বাড়ে। কর্টিসোলের উচ্চমাত্রা ভিসারেল ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ায়। একারণে পেটের চর্বি কমাতে দুশ্চিন্তা দূর করার ব্যায়াম, প্রাণায়াম, ধ্যান ইত্যাদির সাহায্য নিতে হবে। আপনজন ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, গান শোনা, হাসি ঠাট্টা ইত্যাদি মানসিক চাপ কমাতে পারে।
মদ্যপান: Limit Alcohol Intake:
অত্যধিক অ্যালকোহল পান পেটের চর্বি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, উচ্চমাত্রায় অ্যালকোহল গ্রহণ করলে দেহে ভিসারাল ফ্যাটের পরিমাণ বাড়ে। অর্থাৎ অ্যালকোহল পান সারা দেহে চর্বি সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ায়, পেটের চর্বিও বৃদ্ধি করে।
ওজন কমাতে চাইলে ও পেটের চর্বি দূর করতে হলে, অ্যালকোহল পানের পরিমাণ কমাতে হবে। অ্যালকোহল পান বন্ধ করা সব থেকে ভাল। সম্ভব না হলে, মহিলাদের ক্ষেত্রে দিনে 1 পেগ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে দিনে 2 পেগের বেশি অ্যালকোহল পান করা চলবে না।
চর্বি কমাতে কত দিন সময় লাগে? How Long Does It Take to Lose Belly Fat?
কত দ্রুত চর্বি কমবে সেটা বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, বয়স, বংশগতি, খাদ্য তালিকা ইত্যাদি বিষয়ের উপর এটা নির্ভর করে। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা গিয়েছে যে, এক পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় 450 গ্রাম চর্বি কমাতে 3500 ক্যালরি শক্তি পোড়াতে হবে। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে ও ব্যায়াম করে সপ্তাহে 1 থেকে 2 পাউন্ড ওজন কমানো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয়। বেশি দ্রুত ওজন কমানো উচিত নয়। ওজন কমালে সারা শরীর থেকে চর্বির পরিমাণ কমে, একই ভাবে পেটের চর্বিও কমে।
তথ্যসূত্র:
John Hopkins Medicine, Forbes Health, Healthline, Medical News Today, Eating Well, Health,